প্রজেক্টর কিভাবে কাজ করে? কিভাবে দৈত্যাকার পিকচার তৈরি করে?

আমাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি গুলো টেলিভিশনের পর্দায় স্পষ্ট দেখা গেলেও, টেলিভিশন আর রিয়াল লাইফ সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। টেলিভিশনের মধ্যে আকাশ চুম্বী বিল্ডিং গুলোও ১২ ইঞ্চির মধ্যেই এটে যায়, কিন্তু তারপরেও আমরা সেটা উপভোগ করতে পছন্দ করি। কিন্তু যদি টেলিভিশন পিকচার গুলোকে বিরাট আকারের বানিয়ে দেওয়ালের উপর দেখা যেতো—টিভি প্রজেক্টর (TV Projectors) ঠিক এই কাজটিই করে থাকে; এটি ট্র্যাডিশনাল টেলিভিশন থেকে পিকচার গুলোকে ৫-৭ গুন বা আরো অধিক আকারে বড় করে দেখাতে সাহায্য করে, যাতে ভিডিও বা সিনেমাকে আরো ব্যস্তবমুখী করে তোলা সম্ভব হয়। শুধু বাড়িতে সিনেমা উপভোগ করতে নয় বরং ব্যবসা মিটিং, স্কুল, কলেজ লেকচারেও এটি বিস্তরভাবে ব্যবহৃত হয়। আগের দিনের পুরাতন সিআরটি (ক্যাথোড রে টিউব) টিভি বা আজকের এলসিডি এইচডি টিভি অনেক ভালো মানের পিকচার কোয়ালিটি সরবরাহ করলেও এদের সাইজের একটি লিমিটেশন রয়েছে। কোন বিশাল রুমে অবস্থিত থাকা শত শত মানুষকে যদি একই সময়ে একই পিকচার দেখানোর চেষ্টা করা হয়, তবে প্রজেক্টরের কোন বিকল্প হয় না। ব্যাস কোন ডিভিডি প্লেয়ার, কম্পিউটার, বা যেকোনো ভিডিও সোর্স কানেক্ট করে তাৎক্ষনিক ভাবে পিকচারকে দৈত্যাকার বানিয়ে দেখা সম্ভব। কিন্তু এটি কিভাবে কাজ করে? এর পেছনের প্রযুক্তি গুলো কি কি? চলুন বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক…


প্রজেকশন

ছোট বেলায় অনেকের পছন্দনীয় গেম হলো নিচের ছায়াকে ধরার চেষ্টা করা, আর আমি নিজেও এর ব্যতিক্রমে যায়নি। নিজের ছায়া দেওয়ালের উপর পড়া নিয়ে তৎকালীন সময়ে এক আজব চিন্তা জমত আমার মনে, আর এটাই প্রজেকশনের বেসিক ব্যাপার ছিল। অর্থাৎ আমাদের জ্ঞান বুদ্ধি না হওয়া থেকেই আমরা প্রজেকশন দেখে আসছি। আপনার কাছে যদি কোন লাইট সোর্স থাকে এবং তার সামনে যদি কোন অবজেক্টকে তুলে ধরেন তবে ঐ অবজেক্টের হুবহু একটি ইমেজ দেওয়ালের উপর গিয়ে পড়বে। শুধু আজকের দিনে প্রজেক্টরের ব্যবহারে নয় বরং প্রাচীন আমল থেকে আমরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে প্রজেকশন করে আসছি। আলোর সামনে অবজেক্ট রেখে তার ছায়া দেওয়ালে ফেলে, এবং অবজেক্টটিকে নড়াচড়া করে আমরা এনিমেশনও তৈরি করতে পারি। ব্যাস এটাই হলো প্রজেকশনের মূল মন্ত্র।

প্রজেকশন টিভি কিভাবে কাজ করে সেটা বোঝার জন্য ট্র্যাডিশনাল টিভি কিভাবে কাজ করে সেটার উদাহরণ নেওয়া যেতে পারে। সাধারন টিভিতে একটি ফস্ফর্যাস্ প্রলেপিত স্ক্রীনের (Phosphor-Coated Screen) উপর ক্যাথোড রে টিউব থেকে ইলেকট্রন বীম ছুড়ে মারা হয়। প্রত্যেক সময় যখন একটি সিঙ্গেল ইলেকট্রন স্ক্রীনের সংস্পর্শে আসে, সেই সিঙ্গেল পয়েন্টকে পিক্সেল বলা হয়, যেটি উজ্জ্বল হয়ে উঠে। কালার সিআরটি টেলিভিশনে তিনটি ইলেকট্রন বীম থাকে এবং সবুজ, লাল, এবং নীল রঙের তিনটি আলাদা ফস্ফর্যাস্ থাকে; যখন আপনি দূর থেকে এই কালার গুলোর দিকে দেখেন, আপনার কাছে পিকচার মনে হয়।

সিআরটি টিভির কালার প্রেজেন্টেশন এবং পিকচার কোয়ালিটি অনেক ভালো হলেও এর সবচাইতে বড় অসুবিধা হচ্ছে, সর্বউচ্চ ৪০ ইঞ্চি আড়াআড়িভাবে পর্যন্ত সিআরটি স্ক্রীন বানানো সম্ভব। আর ঠিক এই কারণেই প্রজেক্টর বানানোর প্রয়োজন পড়ে যায়; এখানে টিভি’র মতো ডাইরেক্ট-ভিউ টেকনোলজি ব্যবহার না করে, ছোট পিকচার তৈরি করা হয় এবং বড় লাইট বীমের সাহায্যে পিকচারটিকে বড় করে দেখানো হয়।

প্রজেকশনের ধরণ

প্রজেকশন প্রধানত দুইটি প্রধান ধরণে দেখতে পাওয়া যায়; একটি “ফ্রন্ট প্রজেকশন” আরেকটি “ব্যাক প্রজেকশন“।  যদি আলো আপনার পেছনে থাকে এবং স্ক্রীন আপনার সামনে থাকে, আর এভাবে ইমেজ তৈরির মানে হচ্ছে ফ্রন্ট প্রজেকশন। এই ধরনের প্রজেকশনের জন্য প্রজেক্টর এবং স্ক্রীনের প্রয়োজন পড়ে এবং স্ক্রীনের সামনে প্রজেক্টরের অবস্থান থাকা প্রয়োজনীয়। এই ধরনের প্রজেকশন সেটআপ আপনি বিশেষ করে সিনেমা থিয়েটার গুলোতে পাবেন, যেখানে প্রজেকশন ইউনিট টি স্ক্রীন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা অবস্থানে অবস্থান করে। প্রজেকশন ইউনিট টি কোন টেবিলে বা ছাদের সাথে আটকানো থাকে সাথে স্ক্রীন হিসেবে বিশেষ কাপড় অথবা বিশেষভাবে পেইন্ট করা দেওয়াল ব্যবহার করা হয়। টিভি তার জনপ্রিয়তা পাবার আগে, ফ্রন্ট প্রজেকশনই সবচাইতে বেশি জনপ্রিয় ছিল।

তাছাড়া আরেকটি ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেও প্রজেকশন করানো সম্ভব। ব্যাক প্রজেকশন বা রেয়ায় প্রজেকশন সম্পূর্ণ ট্র্যাডিশনাল টিভি’র মতো কাজ করে। এখানে সামনে থেকে স্ক্রীনে আলো না এসে স্ক্রীনের পেছনে আলো লেগে ইমেজ তৈরি করে, যেটা স্ক্রীনের সামনে থাকা দর্শক উপভোগ করতে পারে। এখানে প্রজেক্টর টিভির সাথেই লাগানো থাকে। যেখানে পর্দার পেছনে ইলেক্ট্রনিক ম্যাকানিজম ঘটিয়ে ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়। অর্থাৎ টেলিভিশন নিজেই ব্যাক প্রজেকশনের উদাহরণ।

প্রজেক্টর এর প্রকারভেদ

প্রজেকশন টিভি মূলত দুইটি আলাদা আলাদা প্রযুক্তি একত্রে কাজে লাগিয়ে কাজ সম্পূর্ণ করে; এখানে টেলিভিশন টেকনোলজি কাজে লাগিয়ে প্রথমে ইমেজ তৈরি করে নেওয়া হয় এবং প্রজেক্টর টেকনোলজি কাজে লাগিয়ে ইমেজকে স্ক্রীনে ছুড়ে মারা হয়। প্রজেক্টরের মধ্যে টেলিভিশনের মতোই ইমেজ তৈরি করার জন্য ক্যাথোড রে টিউব থাকে, কিন্তু টিভি থেকে এই সিআরটি’র আকার ছোট হয়। টিভি মতো এখানেও ইমেজ তৈরি করার জন্য ইলেকট্রনকে ফস্ফর্যাস্ প্রলেপিত স্ক্রীনের উপরে ছুড়ে মারা হয়। আপনি নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন, পেছনের কয়েক দশক থেকে টিভি প্রযুক্তিতে পরিবর্তন হয়ে আসছে। প্রথমে ছিল বিশাল কুৎসিত দেখতে সিআরটি টিভি, তারপরে জায়গা দখল করে নিয়েছে ফ্ল্যাট স্টাইলিস এলসিডি টিভি, আর এখন লেটেস্ট টিভি প্রযুক্তি হলো প্লাজমা টিভি, ওলেড টিভি। ঠিক তেমনিভাবে সময়ের সাথে সাথে প্রজেক্টর প্রযুক্তিতেও পরিবর্তন এসেছে এবং আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে আলাদা আলাদা প্রকারের প্রজেকশন টিভি। সকল টিভি প্রযুক্তি যেমন আলাদা উপায়ে কাজ করে, ঠিক তেমনি আলাদা আলাদা প্রজেক্টর প্রযুক্তিও আলাদা উপায়ে কাজ করে। নিচে এর প্রকারভেদ গুলো জেনে নেওয়া যাক…

সিআরটি প্রজেক্টর

এটি সর্বপ্রথম টেকনোলজির প্রজেক্টর, যেটা সম্পূর্ণ ট্র্যাডিশনাল সিআরটি টিভি’র ন্যায় কাজ করে, তবে একে বিশাল শক্তিশালী এক টিভির সাথে তুলনা করতে পারেন। এখানে টিভি’র মতোই লাইট বীম রয়েছে, কিন্তু আকারে অনেক বড়। তিনটি আলাদা কালারের বীম সবুজ, লাল, এবং নীল স্ক্রীনের উপর ইমেজ তৈরি করার জন্য আলো ছুড়ে মারে। সব আলোর বিন্দু গুলো একত্রিত হয়ে স্ক্রীনের উপর একটি সম্পূর্ণ কালার ইমেজ তৈরি করে। কিন্তু এই ধরনের প্রজেক্টর আকারে বিশাল হয়ে থাকে, যেটা একদমই পোর্টেবল নয়, কিন্তু অন্যান্য প্রজেক্টর হতে এটি বেশি কালার এবং পিকচার কোয়ালিটি প্রদান করতে পারে। তবে এটি অনেক বেশি ইলেক্ট্রিসিটি খরচ করে। যাই হোক, যদিও এটি অনেক পুরাতন টেকনোলজির প্রজেকশন সিস্টেম, কিন্তু তারপরেও এটি বর্তমানের এইচডি টিভি, ব্লু-রে প্লেয়ার, ডিভিডি প্লেয়ারের সাথে কাজ করতে সক্ষম।

এলসিডি প্রজেক্টর

যেভাবে এলসিডি টেলিভিশন আসার পরে সিআরটি টিভি’র দিন খতম করে দিয়েছে, ঠিক তেমনি প্রজেক্টরের ক্ষেত্রেও অনেকটা একই ব্যাপার। এলসিডি স্ক্রীন অনেক সস্তা, পাতলা, লো পাওয়ারে চলে, এবং অনেকবেশি উজ্জ্বল। ইলেক্ট্রিক্যাল কারেন্ট লিকুইড ক্রিস্টালের সেইপ পরিবর্তন করে দিতে পারে। আর এই বৈশিষ্ট্য এদের লাইট ভালভে পরিণত করে—বিভিন্ন পরিমানের কারেন্ট বিভিন্ন মাত্রায় ক্রিস্টালের মধ্যদিয়ে লাইট সরবরাহ করে। এলসিডি প্রজেক্টরের ভেতরে একটি ছোট এলসিডি স্ক্রীন লাগানো থাকে, যেটাতে ইমেজ তৈরি হয়। আর স্ক্রীনের সামনে একটি বিস্তর ম্যাগনিফাইড লেন্স লাগানো থাকে, যেটা ছোট স্ক্রীনের পিকচারের আয়তন বাড়িয়ে দেয়ালে বড় সাইজ ইমেজের সৃষ্টি করে। এলসিডি প্রজেক্টর যথেষ্ট পোর্টেবল, তাই বহন করতে এবং বাড়িতে ব্যবহার করার জন্য বিশেষ উপযোগী। কিন্তু সিআরটি প্রজেক্টরের তুলনায় এর কালার কোয়ালিটি একটি নিম্নমানের, তবে হোম ইউজের জন্য সেটা কোন বিশাল ব্যাপার নয়।

ডিএলপি প্রজেক্টর

ডিজিটাল মাইক্রোমিরর ডিভাইজ বা ডিএমডি নামক একটি মাইক্রোচিপের সমন্বয়ে গঠিত এই ডিএলপি প্রজেক্টর; যেটা উদ্ভবনের পরে লেটেস্ট এলসিডি প্রজেক্টরও আদিম টেক বলে মনে হয়। এর মধ্যে একটি আয়তক্ষেত্রাকার চিপের ডিভাইজ রয়েছে যেটার মধ্যে দুই মিলিয়ন মাইক্রোস্কোপিক আয়না রয়েছে। যেমনটা কম্পিউটার প্রসেসর চিপ ট্র্যানজিস্টর দ্বারা গঠিত, ঠিক তেমনি ডিএমডি আয়না (মিরর) দ্বারা গঠিত। একটি উজ্জ্বল আলো এই ডিএমডি চিপকে আলোকিত করে এবং একটি ইলেক্ট্রনিক সার্কিট মিরর গুলোকে ক্রমাগত ঝাঁকাতে থাকে। আমরা জানি আলোর সামনে কোন আয়না এনে সরানরা করালে, আয়নাটি আলো ধরে নেয় এবং আলো প্রতিফলিত করতে থাকে। ঠিক যেমনভাবে আমরা ছোট বেলায় আয়না দিয়ে সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে খেলতাম। চিপের মধ্যে থাকা দুই মিলিয়ন ক্ষুদ্র মিরর পিক্সেল হিসেবে কাজ করে এবং এর মধ্যদিয়ে বিভিন্ন রঙের আলো পরিচালিত করে স্ক্রীনের উপর ইমেজ তৈরি করা হয়। যদি কোন মিররের মধ্যদিয়ে আলো না চালনা করানো হয়, তবে সেটি অন্ধকার থাকে, এবং ব্ল্যাক পিক্সেল হিসেবে কাজে লাগে। ২ মিলিয়ন পিক্সেল মিলে হাই রেজুলেসন ইমেজ তৈরি করতে সক্ষম। তাছাড়া ডিভিডি, ব্লু-রে প্লেয়ার, কম্পিউটার, বা যেকোনো ভিডিও সোর্স থেকে এটি স্ক্রীন প্রজেক্ট করতে পারে।

শেষ কথা

তো বন্ধু এই ছিল প্রজেক্টর নিয়ে সম্পূর্ণ আর্টিকেলের বিষয় বস্তু। এখানে আপনি জানলেন এটি কিভাবে কাজ করে এবং এর কি কি প্রকার বা ধরণ রয়েছে। পরবর্তীতে আরেকটি আর্টিকেল পাবলিশ করে আমি বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করবো, আপনি একটি প্রজেক্টর কেনার সময় কি কি বিষয় গুলো মাথায় রাখবেন। তো আপনি কি কখনো মুভি প্রজেকশন করেছেন? অথবা অফিস প্রেজেন্টেশন? আমাদের নিচে কমেন্ট করে জানাবেন অনুগ্রহ করে।

Images: Shutterstock.com

About the author

তাহমিদ বোরহান

আমি তাহমিদ বোরহান, বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন প্রযুক্তি ব্লগার হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে বাংলায় টেক কন্টেন্ট এর বিশেষ অভাব রয়েছে, তাছাড়া উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট বেশিরভাগ মানুষের মাথার উপর দিয়েই যায়। ২০১৪ সালে প্রযুক্তি সহজ ভাষায় প্রকাশিত করার লক্ষ্য রেখেই ওয়্যারবিডি (পূর্বের নাম টেকহাবস) ব্লগের জন্ম হয়! আর এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আর্টিকেল প্রকাশিত করে বাঙ্গালীদের টেক লাইফ আরো সহজ করার ঠেকা নিয়ে রেখেছি!

সারাদিন প্রচুর পরিমাণে গান শুনি আর ইউটিউবে র‍্যান্ডম ভিডিও দেখি। ওয়ার্ডপ্রেস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভিডিও প্রোডাকশন, এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের উপরে বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। নিজের গল্প, মানুষের গল্প, আর এলোমেলো টপিক নিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে লিখি। খাওয়া আর ঘুম আমার আরেক প্যাশন!

Add comment

Categories