স্মোক ডিটেক্টর কীভাবে কাজ করে? কীভাবে লাখো জীবন বাঁচিয়ে দেয়?

আগুন মানুষকে জীবন দান করতে পারে আবার জীবন কেড়েও নিতে পারে। মুভিতে আর ডিসকভারি চ্যানেলের প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার শো তে অবশ্যই দেখে থাকবেন কীভাবে আগুন থেকে ধোঁয়া তৈরি করে সিগন্যাল পাঠিয়ে মানুষ বেঁচে ফিরে আসতে পারে। সাধারনত আমরা ঘ্রাণ শক্তি ব্যবহার করে যেকোনো কিছু গন্ধ নিতে পারি। কিন্তু আপনি যদি ঘুমিয়ে থাকেন আর আপনার ঘরে দুর্ভাগ্যবশত আগুন লেগে যায়; আগুন আপনার চারপাশের অক্সিজেন চুরি করে নিতে পারে ফলে আপনার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হবে। তাছাড়া আগুন আর ধোঁয়া মিলে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস তৈরি করতে পারে, যা আপনাকে দীর্ঘ কোমায় পাঠিয়ে দিতে পারে, আর হতে পারে সেখান থেকে আপনি আর কখনোই ফিরে আসতে পারবেন না। তবে আজকের দিনে ব্যাপারটি অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ধন্যবাদ না দিলেই নয়—কেনোনা এর বদৌলতেই আমাদের সামনে এসেছে এক সস্তা আর নির্ভরযোগ্য আগুন আর ধোঁয়া ডিটেক্ট করার গ্যাজেট, যা আমরা স্মোক ডিটেক্টর (Smoke Detectors) হিসেবে চিনি। চলুন আজ এই অসাধারণ আবিষ্কারটির সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করি, যেটা প্রতি বছর ঘুমিয়ে থাকা লাখো মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে দেয়।


ফটো ইলেকট্রিক ডিটেক্টর

স্মোক ডিটেক্টর কে আমরা এক নামে জানলেও এদের কিন্তু দুইটি ধরণ রয়েছে। মানে দুইটি ভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রধানত দুই ধরনের স্মোক ডিটেক্টর দেখতে পাওয়া যায়। এক প্রকারকে বলতে পারেন ইলেকট্রিক চক্ষু আর আরেক প্রকারকে বলতে পারেন ইলেকট্রিক নাক। আর্টিকেলের এই অংশে ইলেকট্রিক চোখের ন্যায় স্মোক ডিটেক্টর নিয়ে আলোচনা করবো এবং বাকী অংশে নাক টাইপ স্মোক ডিটেক্টর নিয়ে আলোচনা করবো। চোখের ন্যায় ডিটেক্টরকে অপটিক্যাল স্মোক ডিটেক্টর (Optical Smoke Detector) বা ফটোসেল স্মোক ডিটেক্টর (Photocell Smoke Detector) বা ফটো ইলেকট্রিক ডিটেক্টর (Photoelectric Detectors) বলা হয়।

এই ধরনের ডিটেক্টর আলোর সেন্সরের উপর কাজ করে। যেকোনো সাধারন ফটো বীম ডিটেক্টরে কি ঘটে? দেওয়ালের এক পাশে একটি লাইট লাগানো থাকে (বিশেষ করে লেজার লাইট) এবং ঠিক উল্টা দিকে একটি ফটো ডিটেক্টর লাগানো থাকে যাতে এটি লাইটটিকে দেখতে পায়। এখন আপনি যদি এই লাইটের সামনে দিয়ে চলে যান বা কোন এমন বস্তুকে নিয়ে যান যেটি আলোকে ফটো ডিটেক্টরে পৌঁছাতে বাঁধা প্রদান করবে, তাহলে ফটো ডিটেক্টরটি অ্যালার্ম ট্রিগার দাবিয়ে দেয় এবং অ্যালার্ম বেজে উঠে। অপটিক্যাল স্মোক ডিটেক্টর অনেকটা এই রূপে কাজ করলেও একেবারে এই রূপে কাজ করে না। কেনোনা সরাসরি এই রূপে কাজ করাতে দুটি সমস্যা সামনে আসছে। প্রথমত ধোঁয়া ডিটেক্ট করার জন্য বিশাল ডিটেক্টর লাগাতে হবে, কেনোনা কেবল ঘন ধোঁয়া তৈরি হওয়ার পড়েই আলো ব্লক হবে এবং ডিটেক্টর কাজ করবে। আর দ্বিতীয়ত বিশাল আকারের ডিটেক্টর তৈরি করার পরেও এটিকে খুব বেশি সংবেদনশীল তৈরি করা সম্ভব হবে না।

তাহলে কীভাবে এই টাইপের ডিটেক্টর কাজ করে? অপটিক্যাল ডিটেক্টরে আলো এবং আলো দেখতে পাওয়া সেন্সর দুটিই থাকে, কিন্তু সেটা থাকে ডিটেক্টর গ্যাজেটটির ভেতরে। ইংরেজি “T” অক্ষরের কথা কল্পনা করুন। ধরুন “টি” এর উপরে থাকা সমতল ডাটের এক প্রান্তে একটি লাইট লাগানো আছে যা ডাটের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে আলো ছুড়ে মারছে। এবার কল্পনা করুন “টি”র লম্বা ডাটের তলার দিকে একটি সেন্সর লাগানো আছে। এখন কোন কারণে ঘরে আগুন লেগে ধোঁয়ার সৃষ্টি হলে, ধোঁয়া গ্যাজেটটির মধ্যে প্রবেশ করবে এবং ধোঁয়া কণাতে বাঁধা পেয়ে কিছু আলো সমতল ডাট থেকে ঘুরে নিচের লম্বা ডাটের তোলায় থাকা সেন্সরে এসে পড়বে, আর অ্যালার্ম বেজে উঠবে। আশা করছি আর বুঝতে এক টুকুও বাকী নেই!

আয়োনাইজেসন স্মোক ডিটেক্টর

আরেক ধরনের ডিটেক্টর অপটিক্যাল টাইপ ডিটেক্টর থেকে কম দামের হয়ে থাকে এবং এটিকে ইলেক্ট্রিক্যাল নাক বলতে পারেন। আপনার মুখ মণ্ডলের সামনের দিকে যেমন আপনার নাক থাকে, আর আপনি যেকোনো গন্ধ নিতে পারেন ঠিক তেমনি এই টাইপের গ্যাজেট এক ধরনের রাসায়নিক ব্যাপার কাজে লাগিয়ে অস্বাভাবিক অণু (ধোঁয়া) গুলোকে ডিটেক্ট করতে পারে। আর এই টাইপের ডিটেক্টরকে আয়োনাইজেসন স্মোক ডিটেক্টর (Ionization Smoke Detectors) বলা হয়।

এর এরকম নাম কেন দেওয়া হলো, কেনোনা এতে আয়োনাইজেসন চেম্বার থাকে এবং এটি আয়োনাইজিং রেডিয়েশন ব্যবহার করে স্মোক ডিটেক্ট করে। বাহিরের দিকে একটি আয়োনাইজেসন চেম্বার খোলা থাকে যেটি আয়ন দ্বারা পরিপূর্ণ থাকে। এখন এই আয়ন আসে কোথা থেকে; চেম্বারের ভেতরে অ্যামরেসিয়াম (Americium) নামক এক রাসায়নিক উপাদান বিদ্যমান থাকে যেটি সর্বদা তেজস্ক্রিয় কণা নির্গত করতে থাকে। এই রেডিয়েশন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং বাতাসের কণাতে পজিটিভ আয়ন এবং নেগেটিভ আয়ন তৈরি করে। এখন এখানে একটি ডিটেকশন চেম্বার থাকে যেখানে দুই ধরনের ইলেক্ট্রোড থাকে, বিপরীত ধর্মী ইলেক্ট্রোডকে বিপরীত আয়ন আকৃষ্ট করে, যেমন ব্যাটারির ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। এখন এই সিস্টেম চলাকালীন সময়ে যদি কোন অজানা বা অনাকাঙ্ক্ষিত কণা বা ধোঁয়া গ্যাজেটটির মধ্যে প্রবেশ করে তবে আয়ন গুলো ইলেক্ট্রোডে পৌঁছাতে বাঁধা পায় এবং স্মোক ডিটেক্টর মনে করে কিছু ব্যাপার ঘটছে যা না ঘটার কথা, ফলে এটি অ্যালার্মকে চালু করে দেয়। এখানে উল্লেখ্য যে, ফটো ইলেকট্রিক ডিটেক্টর থেকে আয়োনাইজেসন স্মোক ডিটেক্টর অধিক নির্ভুলতার সাথে কাজ করে।

শেষ কথা

তো এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝে গেছেন মাথার উপর লাগানো থাকা একটি ছোট্ট ডিভাইজ কীভাবে ধোঁয়া এবং আগুনকে ডিটেক্ট করে লাখো জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে। আশা করছি এই অসাধারণ গ্যাজেটটি কীভাবে কাজ করে তা এই আর্টিকেল থেকে পরিষ্কারভাবে জানতে পেড়েছেন। যদিও আর্টিকেলের শেষের অংশটি একটু টেকনিক্যাল দিকে চলে গিয়েছিল, তারপরেও আমি যথা সাধ্য সহজে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। স্মোক ডিটেক্টর নিয়ে আপনার যেকোনো প্রশ্ন থাকলে আমাকে নিচে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন, সাথে মেটাল ডিটেক্টর কীভাবে কাজ করে, সেই অসাধারণ আর্টিকেলটি পড়তে ভুলবেন না।

Images: Shutterstock.com

About the author

তাহমিদ বোরহান

আমি তাহমিদ বোরহান, বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন প্রযুক্তি ব্লগার হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে বাংলায় টেক কন্টেন্ট এর বিশেষ অভাব রয়েছে, তাছাড়া উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট বেশিরভাগ মানুষের মাথার উপর দিয়েই যায়। ২০১৪ সালে প্রযুক্তি সহজ ভাষায় প্রকাশিত করার লক্ষ্য রেখেই ওয়্যারবিডি (পূর্বের নাম টেকহাবস) ব্লগের জন্ম হয়! আর এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আর্টিকেল প্রকাশিত করে বাঙ্গালীদের টেক লাইফ আরো সহজ করার ঠেকা নিয়ে রেখেছি!

সারাদিন প্রচুর পরিমাণে গান শুনি আর ইউটিউবে র‍্যান্ডম ভিডিও দেখি। ওয়ার্ডপ্রেস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভিডিও প্রোডাকশন, এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের উপরে বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। নিজের গল্প, মানুষের গল্প, আর এলোমেলো টপিক নিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে লিখি। খাওয়া আর ঘুম আমার আরেক প্যাশন!

Add comment

Categories