এলটিও ড্রাইভ কি? ক্যাসেট টেপে ডিজিটাল ডাটা?

আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই; ধরুন আপনার বৃহৎ পরিমানে ডাটা সংরক্ষন করার প্রয়োজন পড়লো এবং আপনি সে গুলোকে দীর্ঘ সময়ের জন্য সংরক্ষিত করতে চান, তাহলে কীভাবে করবেন? “দাঁড়ান, আমিই আপনার হয়ে উত্তরটা দেওয়ার চেষ্টা করি” —হতে পারে আপনি কোন দৈত্যাকার সাইজের হার্ডড্রাইভ কিনবেন এবং সেখানে আপনার ডাটা গুলোকে সংরক্ষিত করবেন আর কোন লকার বা সিন্ধুকে ড্রাইভটিকে বন্দী করে ভাববেন আপনার ডাটা গুলো বহুদিন ধরে এভাবেই অক্ষতভাবে সংরক্ষিত থাকবে, তাই না? বেশি পরিমানের ডাটা লম্বা সময় ধরে সংরক্ষিত করার এটি কিন্তু সর্বউত্তম উপায় নয়। আপনি জেনে হয়তো আশ্চর্য হবেন, হার্ডড্রাইভ থেকে ক্যাসেট টেপে আপনি বেশি সময়ের জন্য ডাটা গুলোকে অক্ষতভাবে সংরক্ষিত রাখতে পারবেন। জী হ্যাঁ, ক্যাসেট টেপ! আর এ ধরনের প্রযুক্তি এখনো বেঁচে রয়েছে যার নাম এলটিও ড্রাইভ (LTO Drive) বা এলটিও ডিজিটাল টেপ স্টোরেজ। এই টেপকে বিশেষ করে ডিজিটাল ডাটা সংরক্ষিত করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে এবং এটি বিশাল পরিমানে ডাটা সংরক্ষিত করতে সক্ষম। তাহলে আর দেরি কীসের? —চলুন এই ড্রাইভটির সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক…


স্টোরেজ হিসেবে টেপ?

এলটিও এর সম্পূর্ণ রুপ হচ্ছে; লিনিয়ার টেপ-ওপেন (Linear Tape-Open) আর এটিকে হিউলেট-প্যাকার্ড (এইচপি), আইবিএম, সিগেট টেকনোলজি মিলে তৈরি করে এবং উন্নতি করে। যাই হোক, ক্যাসেট টেপে যে ডাটা স্টোর করা যায় সেটা আমরা আগে থেকেই জানি। অ্যানালগ ক্যাসেট টেপে যেমন টেপ রিলে পেঁচানো থাকে এখানেও ১/২ ইঞ্চির টেপ একটি সিঙ্গেল রিলে পেঁচানো থাকে। ড্রাইভের সাথে মেমোরি চিপ লাগানো থাকে যেটা ড্রাইভে কীভাবে ডাটা স্টোর করা হবে তা বর্ণিত থাকে। হার্ডড্রাইভ আর ফ্ল্যাশ মেমোরি বাজারে আসা খুব বেশি দিন হয়নি, এর আগে বিভিন্ন মিউজিক কোম্পানি, ভিডিও প্রোডাকশন কোম্পানি তাদের ডাটা গুলোকে টেপে সংরক্ষিত করতো, শুধু তাই নয়, এই টেপ প্রযুক্তি ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ডাটা সংরক্ষন/ব্যাকআপ নেওয়ার কাছে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

আপনি জেনে হয়তো আবারো আশ্চর্য হবেন যে, টেপ হার্ডড্রাইভ থেকে অনেক বেশি সময় পর্যন্ত ডাটা সংরক্ষণ করে রাখার ক্ষমতা রাখে। আপনি একটি হার্ডড্রাইভে সকল ডাটা গুলোকে স্টোর করলেন এবং এমনকি সেটা আর ব্যবহার না করে যত্নে রেখে দিলেন, তারপরেও আপনার ডাটা গুলো একসময় নষ্ট হয়ে যাবে। সাধারনত একটি হার্ডড্রাইভ ১০ বছর পর্যন্ত আপনার ডাটা গুলো সংরক্ষিত রাখতে পারে, সেটা যদি আপনি ড্রাইভটি ব্যবহার না করেন, আর ব্যবহার করা ড্রাইভ আরো আগে ফেইল হয়ে যেতে পারে। ১০ বছর পরে হার্ডড্রাইভটি সিস্টেমে যুক্ত করবেন আর দেখবেন আপনার সকল ডাটা গুলো ফুড়ুৎ। কিন্তু এলটিও ড্রাইভ সৌভাগ্যবশত ১৫-৩০ বছর পর্যন্ত আপনার ডাটা গুলোকে অক্ষতভাবে সংরক্ষিত রাখতে পারে। আর এখানে আরেকটি উল্লেখ্য করার মতো ব্যাপার হচ্ছে এই টেপ ড্রাইভের দাম হার্ডড্রাইভ থেকে দ্বিগুণ বা তিনগুন কম।

চিন্তা করে দেখুন ছোট বা বড় কোম্পানি গুলোর কথা যাদের প্রচুর পরিমানে ডাটা সংরক্ষিত করে রাখার প্রয়োজন পড়ে এবং সেটা দীর্ঘ সময়ের জন্য; হার্ডড্রাইভ গুলোর দাম দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে আবার সলিড স্টেট ড্রাইভ গুলোতে তো হাতই দেওয়া যাবে না, দামে পুরা আগুন লেগে আছে! আবার ধরুন আপনি অনেক টাকা ইনভেস্ট করে হার্ডড্রাইভ কিনলেন ডাটা ব্যাকআপ করার জন্য, কিন্তু সেটাও খুব বেশি দিন আপনার ডাটা গুলো সংরক্ষিত করে রাখবে না। সুতরাং এই অবস্থায় টেপ ড্রাইভ বেস্ট সলিউসন হতে পারে।

এলটিও ড্রাইভ জেনারেশন

হার্ডড্রাইভ বা অন্যান্য মিডিয়া স্টোরেজের মতো এলটিও ড্রাইভ প্রযুক্তিতেও অনেক উন্নতি সাধিত হয়েছে এবং বর্তমানে বিশাল পরিমানের ডাটা সংরক্ষিত করার জন্য এটি সম্পূর্ণ প্রস্তুত। এই ড্রাইভ প্রযুক্তির মোট ১০টি জেনারেশন রয়েছে যেখানে এলটিও-১ সর্বপ্রথম এবং এলটিও-১০ সবচাইতে লেটেস্ট জেনারেশন। ১ম জেনারেশনে একটি ড্রাইভে ১০০ জিবি পর্যন্ত ডাটা সংরক্ষিত করা যেতো, তবে ডাটা কমপ্রেস করে ২০০ পর্যন্ত স্টোর করা সম্ভব ছিল এবং ডাটা ট্র্যান্সফার রেট ছিল ২০-৪০ মেগাবাইট/সেকেন্ড। এভাবে ২য়, ৩য়, ৪র্থ, ৫ম, ৬ষ্ঠ, ৭ম, ৮ম, ৯ম জেনারেশনে যথাক্রমে ২০০-৪০০জিবি, ৪০০-৮০০জিবি, ৮০০জিবি-১.৬টেরাবাইট, ১.৫-৩টেরাবাইট, ২.৫-৬.২৫টেরাবাইট, ১৬টেরাবাইট, ৩২টেরাবাইট, এবং ৬২টেরাবাইট ডাটা সংরক্ষিত করা যায় এবং ডাটা ট্র্যান্সফার রেট যথাক্রমে ৪০-৮০মেগাবাইট/সেকেন্ড, ৮০-১৬০মেগাবাইট/সেকেন্ড, ১২০-২৪০মেগাবাইট/সেকেন্ড, ১৪০-২৮০মেগাবাইট/সেকেন্ড, ১৬০-৪০০মেগাবাইট/সেকেন্ড, ৭৮৮মেগাবাইট/সেকেন্ড, ১,১৮০মেগাবাইট/সেকেন্ড, এবং ১,৭৭০মেগাবাইট/সেকেন্ড।

এলটিও-১০ জেনারেশন ড্রাইভের ক্যাপাসিটি ১২০টেরাবাইট পর্যন্ত এবং এটি সর্বউচ্চ ২,৭৫০মেগাবাইট/সেকেন্ড পর্যন্ত ডাটা ট্র্যান্সফার সমর্থন করে। তাছাড়া এলটিও-৪ জেনারেশন থেকে ১০ম জেনারেশন পর্যন্ত হার্ডওয়্যার নির্ভর এনক্রিপশন বা সেলফ এনক্রিপটিং ফিচার দেওয়া রয়েছে, যেখানে আপনার ড্রাইভে কোন ডাটা রীড এবং রাইট করার সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডাটা গুলো অন দ্যা ফ্লাই এনক্রিপ্ট এবং ডিক্রিপ্ট হয়ে যায়।

সুবিধা/অসুবিধা

এতক্ষণের আলোচনা থেকে নিশ্চয় এলটিও ড্রাইভ এর সকল সুবিধা গুলো সম্পর্কে অবগত হয়েই গেছেন। তারপরেও চলুন ঝটপট করে এর সুবিধা গুলো আবার একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। বেশি পরিমানের ডাটা অনেক বেশি সময় ধরে সংরক্ষিত করে রাখার জন্য এটি একটি ভালো প্রযুক্তি। হার্ডড্রাইভ বা যেকোনো ফ্ল্যাশ স্টোরেজ থেকে এর দাম অনেক কম সাথে যেকোনো হার্ডড্রাইভের তুলনায় এটি অনেক বেশি সময় ধরে ডাটা সংরক্ষিত রাখতে পারে। তাছাড়া রীড এবং রাইট এরর ঠেকানোর জন্য এতে বেস্ট প্রোটেকশন রয়েছে, এতে একটি রীড হেড এবং একটি রাইট হেড রয়েছে যেগুলো টেপে ডাটা রীড এবং রাইট করতে সাহায্য করে, ডাটা লস এবং এরর এড়ানোর জন্য একটি আলাদা টেপে ডাটা ব্যাকআপ করে রাখে যাতে ঝটপট ডাটা এরর ফিক্স করা সম্ভব হয়। হার্ডড্রাইভের মতো এলটিও ড্রাইভ এর হেডে কোন মুভিং পার্ট নেই তাই এটি হার্ডড্রাইভ থেকে আরোবেশি টেকসই। তাছাড়া এই ড্রাইভ চলার জন্য নিজে থেকে কোন ইলেক্ট্রিসিটি ব্যবহার করে না।

এর ডাউন সাইড হচ্ছে, যেহেতু এটি টেপের উপর ডাটা সংরক্ষন করে তাই হার্ডড্রাইভের মতো এতে দ্রুত ডাটা অ্যাক্সেস করা সম্ভব হবে না। কোন ডাটা খুঁজে পেতে প্রথমে টেপকে ঐ নির্দিষ্ট জায়গায় ঘুরে যেতে হবে তারপর ডাটা পাওয়া যাবে। যদিও বর্তমানের উন্নত ড্রাইভে র‍্যান্ডম ডাটা অ্যাক্সেস করার প্রসেস আরো দ্রুত করে দেওয়া হয়েছে, তারপরেও এটি হার্ডড্রাইভ বা ফ্ল্যাশ স্টোরেজের মতো দ্রুতগামী নয়। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে একে নির্দিষ্ট এবং সাধারন তাপমাত্রায় সংরক্ষিত করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, এটা একটা বিরক্তিকর ব্যাপার হতে পারে।

মতামত

তো এলটিও ড্রাইভ আপনার জন্য কতটা উপযোগী? —আপনি যদি নর্মাল ইউজার হোন অবশ্যই এটি আপনার জন্য নয়। মানে ক্যাসেট টেপ, সাথে আলাদা ড্রাইভ হার্ডওয়্যার একেবারেই বিরক্তিকর ব্যাপার হতে পারে। তাছাড়া এই ড্রাইভ রীড করার জন্য আলাদা ড্রাইভ কেনার দরকার পড়বে (যেমন সিডি বা ডিভিডি রীড/রাইট করতে কম্পিউটারে সিডি/ডিভিডি রম থাকতে হয়) যেটা কয়েক হাজার ডলার পর্যন্ত খরচের হতে পারে। কিন্তু যদি আপনি কোন ভিডিও প্রোডাকশন স্টুডিও পরিচালনা করেন, বা আপনার যদি বহুদিন পর্যন্ত ডাটা সংরক্ষনের প্রয়োজনীয়তা পড়ে সেক্ষেত্রে অবশ্যই এলটিও ড্রাইভ ট্রাই করা যায়। তাছাড়া আপনি যদি কোন সাধারন ব্যবহারকারী হোন তবে অনলাইন ডাটা ব্যাকআপ সার্ভিস যেমন গুগল ড্রাইভ, ওয়ান ড্রাইভ, ড্রপবক্স ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারেন আর না হলে হার্ডড্রাইভ ব্যাকআপ রাখতে পারেন। আপনি তো আর শতশত বছর ব্যাকআপ রাখছেন না, তাই না?

এই ড্রাইভ সম্পর্কে আগে কখনো শুনেছিলেন? —এই ড্রাইভ সম্পর্কে এতো বিস্তারিত জানার পরেও কি কোন প্রশ্ন আপনার মনে নক করছে? আপনার যেকোনো প্রশ্ন বা মতামত জানাতে নিচে কমেন্ট করতে পারেন।

Images: Shutterstock.com

About the author

তাহমিদ বোরহান

আমি তাহমিদ বোরহান, বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন প্রযুক্তি ব্লগার হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে বাংলায় টেক কন্টেন্ট এর বিশেষ অভাব রয়েছে, তাছাড়া উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট বেশিরভাগ মানুষের মাথার উপর দিয়েই যায়। ২০১৪ সালে প্রযুক্তি সহজ ভাষায় প্রকাশিত করার লক্ষ্য রেখেই ওয়্যারবিডি (পূর্বের নাম টেকহাবস) ব্লগের জন্ম হয়! আর এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আর্টিকেল প্রকাশিত করে বাঙ্গালীদের টেক লাইফ আরো সহজ করার ঠেকা নিয়ে রেখেছি!

সারাদিন প্রচুর পরিমাণে গান শুনি আর ইউটিউবে র‍্যান্ডম ভিডিও দেখি। ওয়ার্ডপ্রেস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভিডিও প্রোডাকশন, এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের উপরে বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। নিজের গল্প, মানুষের গল্প, আর এলোমেলো টপিক নিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে লিখি। খাওয়া আর ঘুম আমার আরেক প্যাশন!

Add comment

Categories