আইরিশ স্ক্যানিং প্রযুক্তি সম্পর্কে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জানুন

আইরিশ স্ক্যানিং প্রযুক্তি কি, এটি কীভাবে কাজ করে, এটির কি কি সুবিধা অসুবিধা রয়েছে এবং ফিঙ্গার প্রিন্ট প্রযুক্তির চেয়ে এটি কতটা নিরাপদ এবং দ্রুততম তা এই পোস্ট এর মাধ্যমে আজ আপনাদের জানানোর চেষ্টা করবো। ৩ টি এমন জিনিষ রয়েছে যা প্রতিটি মানুষের ভেতর বিদ্যমান এবং প্রত্যেকেরটাই আলাদা। প্রথম হচ্ছে ফিঙ্গার প্রিন্ট দ্বিতীয়ত আমাদের ডিএনএ এবং তৃতীয়ত আমাদের আইরিশ এর প্যাটার্ন। দেখুন সাধারন ব্যবহার করার জন্য ফিঙ্গার প্রিন্ট প্রযুক্তি আমরা অনেক ব্যবহার করে আসছি বায়মেট্রিক অ্যাক্সেস এর জন্য। ডিএনএ এর ব্যবহার করা হয় ফরেনসিক সায়েন্স এর কাজ সমূহে। এটি অনেক জটিল বিষয় তাই সাধারনভাবে পরিচয় সনাক্ত করণে আমরা ডিএনএ ব্যবহার করি না।এখন থাকলো আইরিশ স্ক্যানিং এর কথা। দেখুন সাধারন ইলেক্ট্রনিক্স প্রোডাক্ট এ আমারা সহজেই আইরিশ স্ক্যানিং অথবা ফিঙ্গার প্রিন্ট এর ভেতর যেকোনো একটিকে ব্যবহার করতে পারি অথবা দুইটিকেই একসাথেও ব্যবহার করতে পারি।

বন্ধুরা, ফিঙ্গার প্রিন্ট প্রযুক্তি ব্যবহার অনেক সহজ এবং অনেক আগে থেকেই এই প্রযুক্তি আমরা ব্যবহার করে আসছি। এবং এটি অনেক সস্তা হওয়ার জন্য আজ পর্যন্ত আমরা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করি এবং ভবিষ্যতেও ব্যবহার করতে থাকব। সেখানে যদি কথা বলি আইরিশ স্ক্যানিং নিয়ে তবে, এটি এখনো এতোটা সাধারন নয়। কিছু কিছু নির্বাচিত স্থানে আপনি হয়তো এর ব্যবহার দেখতে পাবেন। কিন্তু এই প্রযুক্তি ফিঙ্গার প্রিন্ট প্রযুক্তির তুলনায় অনেক বেশি নিরাপদ, অনেক বেশি দ্রুততম এবং অনেক বেশি দক্ষ। আশা করা যায় সামনের কয়েক বছরের ভেতর এই প্রযুক্তি প্রায় সকল স্মার্টফোন এর জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে।


আইরিশ স্ক্যানিং প্রযুক্তি কীভাবে কাজ করে

চলুন বন্ধুরা এখন জানা যাক যে এই প্রযুক্তি কীভাবে কাজ করে তার সম্পর্কে। দেখুন আমাদের চোখের ভেতর যে প্যাটার্ন থাকে অর্থাৎ যার জন্য আমারা নীল চোখ বা কালো চোখ পার্থক্য করি সেটিকে আমারা আইরিশ বলে থাকি।আইরিশকে বাংলাতে সম্ভবত চোখের পুতলি বলে চিনি। প্রতিটি মানুষের আইরিশ এর প্যাটার্ন আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। মানুষের বয়স ২ বছর থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত এই আইরিশ প্যাটার্ন অপরিবর্তনীয় থাকে। আইরিশ স্ক্যানিং প্রযুক্তিটি অনেকটায় ফিঙ্গার প্রিন্ট প্রযুক্তির মতোই কাজ করে। যেমন আপনি একবার ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যান করলেন তারপর যখন দ্বিতীয়বার অ্যাক্সেস করার জন্য স্ক্যান করবেন তখন আগের স্ক্যান করার ফিঙ্গার প্রিন্ট এর সাথে ম্যাচ করে আপনাকে অ্যাক্সেস দিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে। ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যান এর ক্ষেত্রে ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যানারটি কিন্তু আপনার পুরো আঙ্গুলটি মনে রাখে না। আপনার আঙ্গুলের ছাপ থেকে ৪০-৪৫ টা পয়েন্ট মনে রাখে। আপনার আঙ্গুলের ছাপকে অনেক কাছে থেকে দেখলে বুঝতে পারবেন যে এর ভেতর অনেক গুলো রেখা রয়েছে। এই রেখাগুলো কোথাও তো আবার বৃত্তাকার হয়ে আছে আবার কোথাও রেখা থেকে শাখা প্রশাখা বের হয়েছে। ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যানারটি এই বিশেষ শাখা গুলো মনে রাখে। এবং স্ক্যান করার সময় সেই পয়েন্ট গুলো যাচাই করে অ্যাক্সেস প্রদান করে।

কিন্তু আইরিশ স্ক্যানার এ প্রায় ২৪০-২৫০ টি পয়েন্ট ম্যাচ করার পরে ব্যবহারকারীকে অ্যাক্সেস প্রদান করা হয়। অর্থাৎ এটি ফিঙ্গার প্রিন্ট থেকে প্রায় ৪-৫ গুন পয়েন্ট বেশি ম্যাচ করে তারপর অ্যাক্সেস প্রদান করে। যতোক্ষণ সব পয়েন্ট গুলো সঠিক ভাবে ম্যাচ না করবে ততোক্ষণ অ্যাক্সেস দেওয়া হবে না। এখন কথা বলি এই প্রযুক্তি আসলে কাজ করে কীভাবে তা নিয়ে। আইরিশ স্ক্যানার এ একটি ইনফ্রারেড ক্যামেরা লাগানো থাকে এবং একটি সাধারন ক্যামেরা লাগানো থাকে। এবং এই দুই ক্যামেরাই চোখের আইরিশ এর অনেক হাই-রেজুলেসন ফটো তোলে। ফটো তোলার পরে স্ক্যানারটি আইরিশ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে। এবং আইরিশ থেকে ২৫০ টি পয়েন্ট সংগ্রহ করার পরে এই তথ্যকে একটি এনক্রিপ্ট করা কোড এ পরিবর্তন করে। উদাহরন স্বরূপ মনেকরুন আমি একটি আইরিশ স্ক্যানার দিয়ে স্ক্যান করলাম এর ফলে আমার আইরিশ এর পয়েন্ট গুলো একটি কোড এ পরিবর্তন হয়ে গেলো, মনে করুন কোডটি হলো “১০০১১১০০১০১০১১০১”। এখন যখন আমি অ্যাক্সেস করার জন্য পুনয়ার আইরিশ স্ক্যানিং করবো তখন স্ক্যানারটি আমার চোখের বিদ্যমান পয়েন্ট গুলো প্রথমে নোট করবে তারপর একে কোড এ পরিবর্তন করবে এবং পরিশেষে “১০০১১১০০১০১০১১০১” কোডটির সাথে ম্যাচ করবে। স্ক্যান করা কোডটি মিলে গেলে আমাকে অ্যাক্সেস দিয়ে দেওয়া হবে। তো এই হচ্ছে মুলত আইরিশ স্ক্যানিং প্রযুক্তির কাজ করার ধরণ।

আইরিশ স্ক্যানিং প্রযুক্তি বনাম ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানিং প্রযুক্তি

আইরিশ স্ক্যানিং প্রযুক্তি ব্যবহারকারী প্রমাণীকরণ করার জন্য অনেক আধুনিক এক প্রকারের প্রযুক্তি। ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যানিং প্রযুক্তির চেয়ে এর অনেক বেশি সুবিধা রয়েছে এবং এই প্রযুক্তি অনেক বেশি নিরাপদ। এর সুরক্ষা ব্যাবস্থাকে নষ্ট করা অনেকটা অসম্ভব। তো চলুন এবার আইরিশ স্ক্যানিং প্রযুক্তির কিছু সুবিধা দেখে নেয়া যাক।

  • আমারা জানি যে আমাদের আঙ্গুলের ছাপ আমাদের ত্বকের বাইরে অবস্থিত। অনেক সময় কাজ করার সময় আঙ্গুলে দাগ পড়ে যেতে পারে অথবা আঙ্গুল কেটে যেতে পারে। এই সমস্যা গুলো হওয়ার জন্য অনেক সময় ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যানার আপনার আঙ্গুলটি স্ক্যান করতে ব্যর্থ হতে পারে। এবং আপনি ঝামেলায় পড়ে যেতে পারেন। কিন্তু আইরিশ স্ক্যানিং প্রযুক্তিতে আপনার এই সমস্যা কখনোয় হবে না। কেনোনা চোখের আইরিশ, চোখের ভেতরে থাকে, সেখানে দাগ পড়া বা কেটে যাওয়া অসম্ভব। এবং তার সাথে সাথে আপনাকে স্ক্যানারটিকে টাচ ও করতে হবে না। আপনি বিনা কোনো কিছু ছুঁয়েই নিরাপদ ভাবে স্ক্যান করতে পারবেন, এবং এটি বেশ স্বাস্থ্যকর প্রক্রিয়া।
  • আইরিশ স্ক্যানিং প্রযুক্তিকে বাইপাস করাও ফিঙ্গার প্রিন্ট থেকে অনেক বেশি মুশকিল। আঙ্গুলের ইমপ্রেশন বানিয়ে অথবা প্ল্যাস্টিক আঙ্গুল বানিয়ে ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যানারকে বাইপাস করা সম্ভব। আইরিশ স্ক্যানিং এ যেহেতু আপনার চোখ স্ক্যান করা হয় তাই চোখ এর নকল তৈরি করা বা চোখ উবরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। হাঁ, আগে আইরিশ বাইপাস করার জন্য স্ক্যানার এর সামনে চোখের হাই-রেজুলেসন ফটো ধরা হতো। কিন্তু বর্তমান স্ক্যানার গুলো আপনার জীবন্ত হওয়ারও পরীক্ষা নেবে। আপনার চোখ স্ক্যান করার সময় চোখকে ব্লিং করতে বলা হয়। এতে স্ক্যানারটি সহজেই বুঝে যায় যে এটি আসল চোখ না চোখের ছবি।
  • এই প্রযুক্তি যেহেতু দূর থেকেই কাজ করতে পারে সেহেতু এটি অনেক দ্রুততম একটি প্রযুক্তি। মনে করুন কোনো এর স্থানে এক সাথে অনেক মানুষের স্ক্যান করা প্রয়োজন। সেখানে ফিঙ্গার প্রিন্ট এর তুলনায় আইরিশ স্ক্যানিং বেশি উপযুক্ত হবে। কেনোনা প্রত্যেকজনকে একে একে এসে স্ক্যানারটিতে টাচ করতে হবে না। বরং স্ক্যানার এর সামনে দাঁড়ালেই কাজ ওকে। উদাহরন স্বরূপ বলছি “ইউ এ ই” এর কথা। সেখানে প্রত্যেকটি বর্ডার প্রত্যেকটি সি-পোর্ট এ আইরিশ স্ক্যান এর বাবস্থা আছে। যখন কেও “ইউ এ ই” তে প্রবেশ করে তখন প্রত্যেকের আইরিশ স্ক্যান করে রাখা হয়। পরবর্তীতে কোনো সমস্যা হলে, মনে করুন কোনো হামলা হলো তবে সহজেই কোনো ব্যক্তিকে সনাক্ত করা যায়। তাছাড়াও অনেক পুলিশ কেস এ আইরিশ স্ক্যানার ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

স্মার্টফোন এ আইরিশ স্ক্যানিং প্রযুক্তির ব্যবহার

এখন চলুন জানা যাক স্মার্টফোন এ আইরিশ স্ক্যানিং প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে। স্মার্টফোন এ কি এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা সম্ভব? যদি সম্ভব হয় তবে আজকের দিনে কোন কোন স্মার্টফোনে এই প্রযুক্তি বিদ্ধমান রয়েছে? চলুন সব কিছু জানি। দেখুন আজকালকার দিনে স্মার্টফোনে ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যানিং প্রযুক্তি অনেকটা পান্তা ভাতের মতো। সর্বপ্রথম আইফোন ৫ এস এ সবচাইতে ভালো ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যানার দেখা গেছিলো। তার আগে মটোরোলার ফোন গুলোতেও ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যানার ছিল। কিন্তু আইফোন ৫ এস এর পরে প্রায় সকল ভালো মানের স্মার্টফোন গুলোতেই ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যানার আছে। এখনতো অনেক সস্তা ফোন গুলোতেই এই প্রযুক্তি দেখতে পাওয়া যায়।

কিন্তু আইরিশ স্ক্যানিং একটি অগ্রসর প্রযুক্তি এবং অনন্য প্রযুক্তি হওয়ার জন্য আপনি সকল স্মার্টফোন গুলোতে এখনো এই প্রযুক্তি দেখতে পাবেন না। ফুজিটসু এর একটি স্মার্টফোন ছিল “ফুজিটসু এরো” এতে এই প্রযুক্তি দেখতে পাওয়া গেছিলো। তাছাড়াও মাইক্রোসফট লুমিয়া ৯৫০ এবং ৯৫০ এক্সেল এ এই ফিচারটি দেখতে পাওয়া যায়। যেটি কিনা উইন্ডোজ হ্যালো এর নামে পরিচিত। সারফেস ট্যাবলেট এ ও এই ফিচার দেখতে পাওয়া যায়। তাছাড়াও অনেক চাইনিজ ফোন কোম্পানি জোর করে বলে যে তাদের ফোনে আইরিশ স্ক্যানার আছে। কিন্তু আসলে তাদের ফোনে আইরিশ স্ক্যানার নেই। যেটা আছে সেটি শুধু মাত্র রেটিনা স্ক্যানার। এই স্ক্যানার দিয়ে শুধু মাত্র আপনার চোখের ছবি নেয়া হবে তার পর সেই ছবি ম্যাচ করে পরবর্তী অ্যাক্সেস দেওয়া হয়ে থাকে। সেখানে মোটেও কোনো এনক্রিপ্ট করা কোড জেনারেট করা হয়না। এটা অনেকটা ফেস ডিটেকশন এর মতো কাজ করে। এটা মোটে আইরিশ স্ক্যানার নয়। তবে সামনের দিনে অনেক স্মার্টফোনে এই প্রযুক্তি দেখতে পাওয়া যেতে পারে। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, এই প্রযুক্তি একদিন ফিঙ্গার প্রিন্ট এর স্থান পুরোপুরি ভাবে দখল করতে সক্ষম হবে।

শেষ কথা

তো এই ছিল মুটামুটি আইরিশ স্ক্যানিং প্রযুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত। আশা করি আপনারা অনেক কিছু জানতে পেড়েছেন এই প্রযুক্তি সম্পর্কে। তাই দেরি না করে ঝটপট পোস্টটি শেয়ার করে ফেলুন। এই সাইট টি বেশি বেশি ভিসিট করুন, কেনোনা প্রতিদিন একাধিক প্রযুক্তি চমক থাকছে আপনাদের জন্য। আপনার যেকোনো মতামত যেকোনো প্রশ্ন থাকলে নিচে কমেন্ট করে আমাকে জানিয়ে দিন, আমি সর্বদায় আপনাদের কমেন্ট এর আশাই বসে থাকি। এবং জানতে পছন্দ করি যে আপনারা কি মনে করছেন।

Images: Shutterstock.com

About the author

তাহমিদ বোরহান

আমি তাহমিদ বোরহান, বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন প্রযুক্তি ব্লগার হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে বাংলায় টেক কন্টেন্ট এর বিশেষ অভাব রয়েছে, তাছাড়া উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট বেশিরভাগ মানুষের মাথার উপর দিয়েই যায়। ২০১৪ সালে প্রযুক্তি সহজ ভাষায় প্রকাশিত করার লক্ষ্য রেখেই ওয়্যারবিডি (পূর্বের নাম টেকহাবস) ব্লগের জন্ম হয়! আর এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আর্টিকেল প্রকাশিত করে বাঙ্গালীদের টেক লাইফ আরো সহজ করার ঠেকা নিয়ে রেখেছি!

সারাদিন প্রচুর পরিমাণে গান শুনি আর ইউটিউবে র‍্যান্ডম ভিডিও দেখি। ওয়ার্ডপ্রেস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভিডিও প্রোডাকশন, এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের উপরে বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। নিজের গল্প, মানুষের গল্প, আর এলোমেলো টপিক নিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে লিখি। খাওয়া আর ঘুম আমার আরেক প্যাশন!

Add comment

Categories