এয়ারপ্লেন মুডের সত্যতা : সেলফোন কি সত্যিই এ্যারোপ্লেন ক্র্যাশ করাতে পারে?

ওয়্যারলেস প্রযুক্তিতে আমরা এনেছি অসাধারণ সব পরিবর্তন। আগের ওয়্যারলেস প্রযুক্তিতে অ্যানালগ সিগন্যাল ব্যবহার করা হতো—যেখানে শব্দকে সরাসরি শব্দ রুপেই পাঠানো হতো, কিন্তু বর্তমানে প্রত্যেকটি ওয়্যারলেস প্রযুক্তিতে ডিজিটাল সিগন্যাল ব্যবহার করা হয়—যেখানে প্রত্যেকটি ম্যাসেজকে সংখ্যায় পরিণত করে পাঠানো হয়। প্রত্যেকটি ওয়্যারলেস ডিভাইজে নিঃসন্দেহে আলাদা আলাদা ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ড ব্যবহার করা হয়, যাতে একটি ডিভাইজের সিগন্যাল আরেকটির সাথে পেঁচিয়ে না যায়। কিন্তু যখনই আপনি কোন ফ্লাইটে উঠবেন কোথাও উড়ে যাওয়ার জন্য, একটি ম্যাসেজ আপনার কানে ভেসে আসবে— “অনুগ্রহ করে আপনার সেলফোন এবং ইলেক্ট্রনিক ডিভাইজ গুলো বন্ধ করুন!” প্রশ্ন হচ্ছে, কেন? কেন আমরা এ্যারোপ্লেনে সেলফোন ব্যবহার করতে পারি না? সত্যিই কি সেলফোন কোন এ্যারোপ্লেন ক্র্যাশ করাতে পারে? চলুন এই আর্টিকেলে সকল সত্যতা গুলো খোঁজার চেষ্টা করি…


কেন ফ্লাইটে সেলফোন ব্যান?

এ্যারোপ্লেনে সেলফোন ব্যবহার করলে কি সত্যিই এ্যারোপ্লেন কমিউনিকেশন সিস্টেমের কোন গণ্ডগোল ঘটতে পারে? কেন এই ব্যান? আসলে এ্যারোপ্লেনে প্রধানত দুটি কারণে সেলফোন ব্যান করা হয়েছে। প্রথমটি হলো “সেলফোন টাওয়ারকে রক্ষা করার জন্য” এবং দ্বিতীয়ত “বিমানে মজুদ থাকা কমিউনিকেশন সিস্টেমে যাতে গণ্ডগোল না দেখা দেয়“। আপনি হয়তো ভাবছেন, “বিমানের কমিউনিকেশন সিস্টেমে সেলফোন গণ্ডগোল পাকাতে পারে, সেটা না হয় অনুমান করলাম ব্যাট সেলফোন টাওয়ার রক্ষা? ব্যাপারটা মাথার উপর দিয়ে গেল!” ঠিকআছে, আমি বিস্তারিত আলোচনা করছি।

এই আলোচনার গভীরে যাওয়ার আগে, সেলফোন কিভাবে কাজ করে —তার উপরে লেখা আমার আলাদা আর্টিকেলটি পড়া জরুরী। যাই হোক, আপনি যখন সেলফোন থেকে কোথাও কল করেন তখন আপনার সেলফোনটি সবচেয়ে নিকটবর্তি টাওয়ারের সাথে যোগাযোগ করে। টাওয়ারের সাথে যোগাযোগ করার সময় আপনার ফোনটি তার ছোট অ্যান্টেনা থেকে সামান্য কিছু সিগন্যাল ছুড়ে মারে এবং কোন টাওয়ারকে তার রেঞ্জের মধ্যে পেলে তার সিগন্যাল ব্যবহার করে কল ট্র্যান্সমিট করে। যখন আপনি কোন চলন্ত যানবাহনে যেমন- বাস বা কারে চলাকালীন সময়ে সেলফোন ব্যবহার করেন, তখন আপনার ফোনটি এর নিজের অবস্থান এবং এরিয়া পরিবর্তনের সাথে সাথে সেল টাওয়ারও পরিবর্তন করে এবং এই প্রসেসটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটে।

কিন্তু কোন সেলফোন টাওয়ারকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয় না যে এটি ১০ হাজার ফিট উপর থেকে প্রতি ঘণ্টায় কয়েকশো মাইল স্পীডে থাকা ফোন থেকে সিগন্যাল রিসিভ করবে বা টাওয়ার সুইচিং করবে। প্লেনে আপনার ফোন চলা কালীন সময়ে একসাথে অনেক দ্রুত টাওয়ার পরিবর্তন করার প্রয়োজন পড়ে এবং একই সাথে একই সময়ে অনেক টাওয়ার থেকে সিগন্যাল আসে। এতে সেলফোন সিস্টেম বিভ্রান্ত হয়ে যায়, কোন টাওয়ার থেকে সিগন্যাল নেবে আর কোনটিকে পরিবর্তন করবে। এই সমস্যার ফলে টাওয়ার গুলোর পারফর্মেন্স কমে যেতে পারে এবং ভূমিতে থাকা ইউজারদের সেলফোন ব্যবহার করতে অসুবিধা ঘটতে পারে। আবার আপনার ফোনটি যখন একসাথে অনেক টাওয়ার থেকে সিগন্যাল পেতে আরম্ভ করবে তখন এর ব্যাটারি পাওয়ারও বেশি খরচ হবে এবং ফোন থেকে অনেক বেশি রেডিও সিগন্যাল ক্ষরণ ঘটবে।

ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন

উপরের বিষয়টি অনুধাবন করে মনে হতে পারে, যে ঠিক আছে এ্যারোপ্লেনে সেলফোন ব্যবহার না করার এটি একটি কারন হতে পারে। তবে এই কারনের ফলে কি কোন এ্যারোপ্লেন ক্র্যাশ করবে? এর সঠিক উত্তর দেওয়ার আগে চলুন আরেকটি ফ্যাক্ট নিয়ে জেনে নেওয়া যাক। সেলফোন থেকে শুরু করে প্রায় প্রত্যেকটি ইলেক্ট্রনিক ডিভাইজ থেকে ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন বেড় হয়। আপনার ল্যাপটপ, পোর্টেবল ডিভিডি প্লেয়ার, পোর্টেবল গেমিং স্টেশন ইত্যাদি সব ডিভাইজই ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন নির্গত করে। সাধারণত এ্যারোপ্লেন ভূমি ছাড়ার সময়ে এবং ভূমিতে ফিরে আসার সময়ে সকল ইলেক্ট্রনিক ডিভাইজ গুলোকে বন্ধ করে রাখতে বলা হয় এবং সেলফোন সবসময়ের জন্যই ব্যান থাকে।

একটি এ্যারোপ্লেনে অনেক ধরনের রেডিও ডিভাইজ থাকে, যদিও এগুলো সেলফোন বা অন্য ডিভাইজের থেকে আলাদা ফ্রিকোয়েন্সিতে কাজ করে। প্লেনে একটি রেডিও থাকে, যেটার মাধ্যমে পাইলটেরা গ্রাউন্ড কন্ট্রোল এবং এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলের সাথে যোগাযোগ করে। আরেক ধরনের রেডিও প্লেনের অবস্থান এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলের কম্পিউটারে দেখাতে সাহায্য করে। তাছাড়া প্লেন ন্যাভিগেশনের জন্য এতে জিপিএস ট্র্যান্সমিটার থাকে। এখন সেলফোন এমন একটি ডিভাইজ যা সর্বদা সিগন্যাল আদান প্রদান করেই চলেছে। তাই হতে পারে সেলফোনের সিগন্যাল প্লেনের কোন একটি রেডিও সিগন্যালের সাথে গণ্ডগোল পাকাতে পারে। তবে বলে রাখি, এটা ঘটার সুযোগ অনেক কম। তবে আরো বেশি সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সেলফোনকে বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়। তাছাড়া অনেক ডিভাইজ থেকে একত্রে ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন বেড় হওয়ার ফলে জিপিএস সিস্টেম একটু অসুবিধায় পড়তে পারে। জিপিএস স্যাটেলাইট এতে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এতে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে যেমন- ফুটবল মাঠে ভীরের মধ্যে মাঠের বাহির থেকে কাওকে ডাকার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়।

তাছাড়া আপনি হয়তো নিজেও লক্ষ্য করে দেখে থাকবেন, আপনার সেলফোনটি যদি আপনার কম্পিউটার স্পীকারের পাশে রাখা হয় এবং আপনার সেলফোনে কল আসলে স্পীকারে প্রচণ্ড স্ট্যাটিক শব্দ (বিপবিপ, পটপট, টকটক) তৈরি হয়। ঠিক এভাবেই সেলফোন সিগন্যাল এ্যারোপ্লেন রেডিওতে স্ট্যাটিক শব্দ তৈরি করতে পারে। ফলে পাইলট ভুল তথ্য শুনতে পারতে পারে এবং বিভ্রান্তি ঘটতে পারে।

তবে এগুলো সবই সম্ভাব্য সমস্যা, মানে এগুলো যে ঘটবেই এতে কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই প্লেনে সেলফোন ব্যবহার করলে যে প্লেন ক্র্যাশ হয়ে যাবে এমনটা সত্য নয়। তবে অনাকাঙ্ক্ষিত কোন ছোট খাট সমস্যাও যাতে না ঘটে সেগুলো এড়াতে এরকম ব্যান এখনো রাখা হয়েছে। যেমন সেলফোনের কারণে প্লেনের স্মোক ডিটেক্টর অন হয়ে যেতে পারে, আর প্লেনে এরকম ছোট খাট সমস্যাও অনেক ভয় ভীতির সৃষ্টি ঘটাতে পারে।

শেষ কথা

ভবিষ্যতে হয়তো মোবাইল অপারেটররা তাদের টাওয়ারকে এমনভাবে প্রস্তুত করবে যাতে এ্যারোপ্লেন থেকেও কথা বলা যায় এবং ভবিষ্যতে হয়তো প্লেনে সেলফোনের ব্যান সরিয়ে নেওয়া হবে—কেনোনা এতে বিপদের আসঙ্খা অতি সামান্য। তাছাড়া বর্তমানে বিমানে ওয়্যারলেস ইন্টারনেট সুবিধা থাকে এবং তার মাধ্যমে স্কাইপ বা যেকোনো ভিওআইপি কল সুবিধা ব্যবহার করে কল করা যেতে পারে। তবে এ্যারোপ্লেনে সেলফোন ব্যবহার করলে যে প্লেন ক্র্যাশ হয়ে যাবে এটি সম্পূর্ণই ভুল ধারণা।

আপনি কি কখনো ফ্লাইটে ওয়্যারলেস ইন্টারনেট ব্যবহার করেছেন? এ্যারোপ্লেনে সেলফোন সংক্রান্ত আপনার যেকোনো অভিজ্ঞতা থাকলে নিচে তা কমেন্টে আমাদের সাথে শেয়ার করুন। তাছাড়া আপনি যেকোনো প্রশ্নে বা আপনার মতামত জানাতে নিচে কমেন্ট করতে পারেন

Images: Shutterstock.com

About the author

তাহমিদ বোরহান

আমি তাহমিদ বোরহান, বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন প্রযুক্তি ব্লগার হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে বাংলায় টেক কন্টেন্ট এর বিশেষ অভাব রয়েছে, তাছাড়া উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট বেশিরভাগ মানুষের মাথার উপর দিয়েই যায়। ২০১৪ সালে প্রযুক্তি সহজ ভাষায় প্রকাশিত করার লক্ষ্য রেখেই ওয়্যারবিডি (পূর্বের নাম টেকহাবস) ব্লগের জন্ম হয়! আর এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আর্টিকেল প্রকাশিত করে বাঙ্গালীদের টেক লাইফ আরো সহজ করার ঠেকা নিয়ে রেখেছি!

সারাদিন প্রচুর পরিমাণে গান শুনি আর ইউটিউবে র‍্যান্ডম ভিডিও দেখি। ওয়ার্ডপ্রেস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভিডিও প্রোডাকশন, এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের উপরে বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। নিজের গল্প, মানুষের গল্প, আর এলোমেলো টপিক নিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে লিখি। খাওয়া আর ঘুম আমার আরেক প্যাশন!

Add comment

Categories