এই হচ্ছে চাইনিজ ফোন গুলো সস্তা হওয়ার আসল কারণ সমূহ! [২০২০]

এটা স্বীকার করতেই হবে, চাইনিজ ফোন কোম্পানি গুলো না থাকলে অনেকেই হয়তো স্মার্টফোন আফর্ডই করতে পারতেন না। স্মার্টফোন কিনতে গেলে কতো টাকার প্রয়োজন? ৫০ হাজার বা ১ লাখ? — সেটা তো স্যামসাং বা অ্যাপেল ডিভাইজ গুলোর ক্ষেত্রে! মার্কেটে ৫-১০ হাজার টাকা দিয়েও অনেক স্মার্টফোন পাওয়া যায় আর এর মধ্যে অনেক ফোন সত্যিই ভাল্যু ফর দ্যা ম্যানি!

শাওমি, অপ্পো, ভিভো, ইউমিডিজির মতো কোম্পানি গুলো স্যামসাং বা অ্যাপেলের অর্ধেক দামের চেয়ে ও কম দামে ফোন সাপ্লাই করে থাকে। হাই এন্ড স্পেসিফিকেশন প্রদান করার পরেও নানান চাইনিজ ফোন গুলো দাম একেবারেই হাতের নাগালে হয়ে থাকে, কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব করে এই চাইনিজ কোম্পানি গুলো? ২০১৬ সালের দিকে এই নিয়ে একটি আর্টিকেল পাবলিশ করেছিলাম, “চাইনিজ ফোন গুলো কেনো এত সস্তা হয়? চাইনিজ ফোন কি কেনা উচিৎ?” কিন্তু এই পর্যন্ত অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে।

কোয়ালিটি থাকা সর্তেও কিভাবে এরা এতো কম দামে ফোন সাপ্লাই করে, কেন স্যামসাং বা আলাদা প্রিমিয়াম ব্র্যান্ড গুলো সেটা করতে পারে না? চাইনিজ কোম্পানি গুলোকি আমাদের ফোন গুলো দান খয়রাত করে? চলুন, আলোচনা করা যাক, ২০১৯ সালে চাইনিজ ফোন গুলো কেন এতো সস্তা?


সস্তা কর্মী

চাইনিজ ফোন গুলো দামে অনেক সস্তা হয়ে থাকে এর অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে চায়নাতে সস্তায় অনেক কর্মী পাওয়া যায়। দুনিয়াতে চায়নায় অনেক কমদামে কর্মী পাওয়া যায়, এই জন্যই দুনিয়ার অনেক কোম্পানির কারখানা চায়নাতে অবস্থিত! চায়নাতে Xingcheng নামক এক শহর রয়েছে যেটাকে চাইনিজ সিলিকন ভ্যালি বলতে পারেন, এখানে শুধু ফোন নয় যেকোনো টাইপের ইলেকট্রনিক্স পার্টস পাওয়া যায় এখানে।

চাইনিজ কোম্পানি ফোন থেকে কোন টাকা উপার্জন করেন না!

অনেক চাইনিজ কোম্পানি রয়েছে যারা ফোন থেকে কোন টাকাই উপার্জন করে না। যেমন- শাওমি, তাদের ফোনের স্পেসিফিকেশন অনেক বেটার হয়, আপনি যা খরচ করেন সেই দামের মধ্যে আপনাকে বেস্ট প্রোডাক্ট তারা হাতে ধরিয়ে দেয়। ভালো বিল্ড কোয়ালিটি, ভালো ক্যামেরা, ভালো চিপসেট, সবকিছু। কিন্তু তারা ফোন থেকে কোন অর্থ উপার্জন করে না, তাদের ফোন বানাতে যা খরচ হয় সেটা দিয়েই আপনি কিনে নেন, এই জন্য এই চাইনিজ ফোন গুলো মারাত্মক সস্তা হয়ে থাকে।

শাওমি এক প্রকারের লং টার্ম চিন্তা ভাবনা করে, যেমন- আপনার কাছে প্রথমে ফোন সেল করলো তারপরে আপনার কাছে আলাদা ফোনের এক্সসিরিজ সেল করে বাড়তি কিছু টাকা ইনকাম করবে। এরকম কোম্পানি চায় মানুষ তাদের নাম জানুক, তাদের উপরে বিশ্বাস আনুক, তারপরে যখন সবাই তাদের সেলফোন ইউজ করতে শুরু করবে তারা আলাদা কিছু এক্সসিরিজ সেল করে টাকা কামাতে পারবে।

তবে সকল চাইনিজ ফোন নির্মাতারা এই জিনিষ অনুসরণ করেনা, যেমন- হুয়াওয়ে বা অপো, এটা ফোন সেল করেই সেখান থেকে প্রফিট বের করে, বসে থাকে না আলাদা এক্সসিরিজ সেল করার আশায়। আবার অনেক ছোট চাইনিজ কোম্পানি রয়েছে যেমন- ইউমিডিজি, এরাও এই স্ট্রাটেজি অনুসরণ করে না, কেনোনা তাদের ফাইন্যান্সিয়াল দিকটা এতোটা উন্নত নয়।

বৈপ্লবিক কিছু নেই এদের

ব্যাপারটা সম্পূর্ণ সত্য নয়, এখন অনেক চাইনিজ কোম্পানি নিউ টেক নিয়ে কাজ করছে যেগুলো এখনো স্যামসাং বা আলাদা প্রিমিয়াম ফোন কোম্পানি গুলো করে উঠতে পারেনি। তবে এই ইনোভেশনের পরিমাণ খুবই কম। এই চাইনিজ কোম্পানি গুলো তাদের ফোনে লো গ্রেড বা একটু পুরাতন মানের হার্ডওয়্যার যুক্ত করে দাম আর পারফর্মেন্সের রেশিও ঠিক রাখে।

অপরদিকে স্যামসাং এর মতো কোম্পানি গুলো বাজারের সবচাইতে হাই কোয়ালিটি পার্টস গুলো কিনে তাদের ফোনে সেট করে। অনেক সস্তা চাইনিজ ফোন গুলোতে দেখবেন মিডিয়াটেকের প্রসেসর ইউজ করা হয় বেশি। মিডিয়াটেক বাজেট সিপিইউ বাজারে আনে, আর যেহেতু মিডিয়াটেক নিজেও এক চাইনিজ কোম্পানি তাই লোকাল চাইনিজ ফোন কোম্পানির কাছে সস্তায় প্রসেসর সাপ্লাই করতে পারে।

চাইনিজ ফোন সস্তা ফোন গুলো জাস্ট বাজারের সস্তা হার্ডওয়্যার গুলোকে প্যাকড করে ফোন বিল্ড করে। তারা জাপানি বা কোরিয়ান স্ক্রীন ব্যবহার করে ফোনে, যেগুলো ওলেড, অ্যামোলেড, বা আইপিএস প্যানেল থেকে অনেক বেশি সস্তা! যেখানে স্যামসাং লেটেস্ট র‍্যাম ইন্সটল করিয়ে দেয় ফোনে, সস্তা চাইনিজ কোম্পানি গুলো এখনো LPDDR3 র‍্যামেই পরে রয়েছে। এতে চাইনিজ কোম্পানি গুলো অনেক কম দামে ফোন সরবরাহ করতে পারে।

চাইনিজ কোম্পানি গুলোর মার্কেটিং বাজেট লো

স্যামসাং বা অ্যাপেল মার্কেটিং এর জন্য কেমন খরচ করে কোন আইডিয়া আছে? ওয়েল, মিলিয়ন খানেক তো খরচ করেই তাই না? আপনি জেনে হয়তো অবাক হবেন না, এই কোম্পানি গুলো আসলে মার্কেটিং এর জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে। এই মার্কেটিং কস্ট গুলো ফোনের দামের মধ্যেই ধরা থাকে, তাই এদের প্রোডাক্ট গুলোর দাম একটু বেশি হয়ে যায়।

অপরদিকে চাইনিজ কোম্পানি গুলো জিরো মার্কেটিং বাজেট নিয়ে নেমে পরে। অনেক কোম্পানি কেবল অ্যামাজন বা আলিএক্সপ্রেসেই দেখতে পাওয়া যায়। মানে এরা অনলাইনে ফ্ল্যাশ সেল করে বিজনেস করে। আলাদা কোন বিলবোর্ড ভাঁড়া করতে হয় না, টিভি কমার্শিয়াল চালাতে হয় না, কোন বড় ইভেন্টকে স্পন্সর ও করতে হয় না, আবার কোন ফেমাস সেলিব্রেটিকে মিলিয়ন ডলার ও দিতে হয় না। এরা মূলত সোশ্যাল মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে মার্কেটিং করে যেখানে তুলনা মূলকভাবে অনেক কম খরচ করতে হয়। কিছু চাইনিজ ব্র্যান্ড মার্কেটিং এ টাকা খরচ করে কিছুটা, কিন্তু সেটা স্টাব্লিসড ব্র্যান্ড গুলোর তুলনায় অনেক বেশি কম!

লিমিটেড স্টক

বড় বড় কোম্পানি গুলো যেমন- স্যামসাং, এলজি, অ্যাপেল — ফোন বাজারে আনার আগেই লাখো ইউনিট তৈরি করে ফেলে। এই সময়ে কিন্তু তারা জানে না তাদের ফোন কেমন চলবে বা কতো বিক্রি হবে। পকেট থেকে টাকা ঢেলে তারা আগে থেকেই প্রোডাক্ট তৈরি করে রেডি করে রাখে। অপরদিকে চাইনিজ কোম্পানি গুলোর স্টক খুবই লিমিটেড হয়ে থাকে।

বড় কোম্পানি গুলো প্রোডাকশনের জন্য আগেই বিলিয়ন বিলিয়ন খরচ করে বসে থাকে। চাইনিজ কোম্পানি গুলো কিছু প্রোডাক্ট তৈরি করে তারপরে অনলাইনে ডিস্কাউন্ট দিয়ে ফ্ল্যাশ সেল দেয় এতে তাড়াহুড়ো করে অনেক ফোন সেল হয়ে যায় তারপরে সেই টাকা দিয়ে আবারো প্রোডাকশন শুরু করে। অনেক কোম্পানি তো অর্ডার প্লেস হওয়ার পরে ফোন তৈরি করা শুরু করে এতে রিস্ক থাকে না, তারা অলরেডি জানে কতো গুলো ইউনিট সেল হতে চলেছে।

রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে কোন খরচ করে না

মার্কেটে যে ডিজাইন অলরেডি রয়েছে, সেই ডিজাইন তুলে নিয়ে জাস্ট চাইনিজ কোম্পানি গুলো কপি/পেস্ট করতে থাকে। এরা নতুন টেক রিসার্চ বা ডেভেলপমেন্টে কোন খরচ করে না। চায়নার আইন অনুসারে সহজেই আপনার তৈরি করা কিছু যে কেউ কপি করে ফেলতে পারে, এতে এদের আইনে তেমন একটা আটকায় না। এই জন্যই দেখবেন এক চাইনিজ ব্র্যান্ডের ফোন গুলো দেখতে আরেক ব্র্যান্ডের ফোন গুলো মতো। যেমন- ইউমিডিজি এ৫ প্রো দেখতে হুয়াওয়ে পি৩০ এর মতো!

এদের নিজেদের প্রসেসর ডেভেলপমেন্ট করতে হয় না, নিজেদের ডিসপ্লে টেক বানাতে হয় না, কিছুই করতে হয় না নিজে থেকে, জাস্ট অন্যের কপি পেস্ট করলেই হয়ে যায়। তবে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আর এমন নেই। শাওমি, অপো, ভিভো এরা এখন রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে খরচ করে, কিন্তু সেটা স্যামসাং বা অ্যাপেলের তুলনায় অনেক কম। অপরদিকে হুয়াওয়ে কিন্তু রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে এখন ভালোই খরচ করে!

তো এই ছিল কিছু বেসিক আইডিয়া, যেগুলো থেকে সহজেই হয়তো বুঝতে পারছেন কিভাবে চাইনিজ কোম্পানি গুলো এতো কমে ফোন সেল করতে পারে। ইউমিডিজির কিছু ফোন দেখলে মনে হয় অ্যাল্ট্রা প্রিমিয়াম কিন্তু দাম অনেক কম হয়ে থাকে। এরমানেই আপনি কিন্তু বলতে পারবেন না ফোন গুলো ফালতু, অবশ্যই হাই এন্ড নয়, কিন্তু সস্তা বলেই কিন্তু ফাৎরা মার্কা নয়।

বড় কোম্পানি গুলো ফোনের দামের সাথে আরো কিছু চার্জ যুক্ত করে দেয়, এতে তাদের ডিভাইজ বেশি দামী হয়ে যায়। তো আপনি এখন জানলেন চাইনিজ ফোন গুলো কিভাবে এতো সস্তা হয়! আপনার কাছে আরো কিছু পয়েন্ট থাকলে আমাদের নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন।

Images: Shutterstock.com

About the author

তাহমিদ বোরহান

আমি তাহমিদ বোরহান, বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন প্রযুক্তি ব্লগার হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে বাংলায় টেক কন্টেন্ট এর বিশেষ অভাব রয়েছে, তাছাড়া উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট বেশিরভাগ মানুষের মাথার উপর দিয়েই যায়। ২০১৪ সালে প্রযুক্তি সহজ ভাষায় প্রকাশিত করার লক্ষ্য রেখেই ওয়্যারবিডি (পূর্বের নাম টেকহাবস) ব্লগের জন্ম হয়! আর এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আর্টিকেল প্রকাশিত করে বাঙ্গালীদের টেক লাইফ আরো সহজ করার ঠেকা নিয়ে রেখেছি!

সারাদিন প্রচুর পরিমাণে গান শুনি আর ইউটিউবে র‍্যান্ডম ভিডিও দেখি। ওয়ার্ডপ্রেস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভিডিও প্রোডাকশন, এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের উপরে বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। নিজের গল্প, মানুষের গল্প, আর এলোমেলো টপিক নিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে লিখি। খাওয়া আর ঘুম আমার আরেক প্যাশন!

Add comment

Categories