আপনি এতদিনে অবশ্যই লিব্রা টার্মটি অনেকবার ফেসবুক বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিভিন্ন অনলাইন পাবলিকেশনে শুনে থাকবেন। হয়তো এটাও জেনে থাকবেন যে এটি ফেসবুকের কোন একটি নতুন প্রোজেক্ট যেখানে তারা একটি নতুন গ্লোবাল কারেন্সি তৈরি করছে। লিব্রা সম্পর্কে আপনার বেসিক জ্ঞান যদি এইটুকুই হয়ে থাকে, তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্যই।
ফেসবুকের তৈরি এই নতুন লিব্রা কারেন্সি বা লিব্রা নামক ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়েই আজকে বিস্তারিত আলোচনা করবো। তাছাড়া লিব্রা কারেন্সি নিয়ে ফেসবুকের ফিউচার প্ল্যান কি, এটি কিভাবে কাজ করবে, অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলো থেকে লিব্রা কিভাবে এবং কতটুকু আলাদা, লিব্রা প্রযুক্তির দুনিয়ায় যে পরিমান হাইপ তৈরি করেছে, এটি আসলেই তার যোগ্য কি না, এই সব বিষয়গুলো নিয়েই কম-বেশি আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
তার আগে বলে নিই, লিব্রা যেহেতু মুলত আরেকটি ক্রিপ্টোকারেন্সি, তাই আপনার যদি ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ক্রিপ্টোকয়েন সম্পর্কে আগে থেকে কিছু জানা না থাকে, তাহলে এই আর্টিকেলটি পড়ার আগে নিচের আর্টিকেল থেকে বিটকয়েন সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন। ফেসবুকের এই নতুন লিব্রা কারেন্সি, টেকনিক্যালি বিটকয়েনের মতোই আরেকটি ক্রিপ্টোকয়েন মাত্র।
লিব্রা কি?
যেমনটা প্রথমেই বললাম বা আপনি অলরেডি জানেন, লিব্রা টেকনিক্যালি জাস্ট আরেকটি ট্রেডিশনাল ক্রিপটোকারেন্সি। তবে লিব্রা-র সাহায্যে ফেসবুক ডিজিটাল মানি বা ডিজিটাল কারেন্সিকে একটি নতুন রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছে এবং ফেসবুক আশা করছে তাদের এই নতুন লিব্রা কারেন্সি ভবিষ্যতে একটি মেইনস্ট্রিম গ্লোবাল কারেন্সি হিসেবে সারা পৃথিবীতে ব্যাবহার হবে যেটা এখনও পর্যন্ত অন্য কোন ক্রিপ্টোকারেন্সির ক্ষেত্রে সম্ভব হয়নি।
ফেসবুক তাদের এই নতুন ক্রিপ্টোকারেন্সি আগামী বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের প্রথম দিকে লঞ্চ করবে। তবে লিব্রা কারেন্সি নিয়ে ফেসবুকের কনসেপ্ট এবং সম্পূর্ণ বিজনেস মডেল অনুযায়ী এটিকে বিটকয়েনের থেকে বেশি পেপ্যাল বা বাংলাদেশের বিকাশের মতো পার্সোনাল ই-ওয়ালেটের মতোই মনে হয়। ফেসবুক এই সম্পূর্ণ সিস্টেমটিকে এমনভাবে ডিজাইন করবে এবং এমন সব ফিচারস ব্যাবহার করে তৈরি করবে যাতে যেকোনো ইউজারের জন্য এটি ব্যাবহার করা খুবই সহজ হয় (যেমনটা ট্রেডিশনাল ক্রিপটোকারেন্সির ক্ষেত্রে হয়না)। আর হ্যা, লিব্রা অ্যাসোসিয়েশন হবে একটি নন-প্রোফিট অরগানাইজেশন। অর্থাৎ, লিব্রা অ্যাসোসিয়েশন এটার থেকে কোন প্রোফিট জেনারেট করবে না।
এখন লিব্রা জিনিসটি কি বা কিভাবে কাজ করে এটার টেকনিক্যাল ব্যাখ্যা বললে আপনি হয়তো বুঝবেন না যদি না আপনার আগে থেকে ব্লকচেইন টেকনোলজি এবং ক্রিপটোকারেন্সি সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকে। তাই টেকনিক্যাল টার্মস না বলে সহজ ভাষায় বলি, লিব্রা হচ্ছে পেপ্যাল বা বিকাশ এর মতো ডিজিটাল ক্যাশ যেটা আপনি ভার্চুয়ালি যেকারো সাথে লেনদেন করতে পারবেন। যেমনটা বলেছি, ক্রিপ্টোকারেন্সি হলেও এটা জাস্ট আরেকটি ডিজিটাল ক্যাশ বা ই-ওয়ালেটের মতোই কাজ করবে।
আপনি ফেসবুকের আপকামিং লিব্রা ওয়েলেট অ্যাপ ব্যাবহার করে লিব্রা কয়েন কিনতে পারবেন যা আপনার লিব্রা ওয়ালেটে জমা থাকবে, ঠিক যেমন আপনার পেপ্যাল অ্যাকাউন্টে ডলার থাকে বা আপনার বিকাশ অ্যাকাউন্টে টাকা জমা থাকে। এরপর আপনি এই লিব্রা কয়েন ভার্চুয়ালি যেকাউকে সেন্ড করতে পারবেন যার আরেকটি লিব্রা ওয়ালেট আছে। এছাড়া আপনি আপনার লিব্রা ওয়ালেট থেকে লিব্রা কয়েনে পেমেন্টও করতে পারবেন যেসব জায়গায় লিব্রা পেমেন্ট অ্যাক্সেপ্ট করা হবে, একেবারেই পেপ্যাল বা বিকাশের মতো।
এই লিব্রা কয়েন সেন্ড করার জন্য বা স্পেন্ড করার জন্য ফেসবুক ক্যালিব্রা নামের একটি স্ট্যান্ডঅ্যালোন অ্যাপ তৈরি করবে। তাছাড়া ডিরেক্ট ফেসবুক মেসেঞ্জার এবং হোয়াটসঅ্যাপ থেকেও এই লিব্রা কয়েন সেন্ড/রিসিভ বা স্পেন্ড করা সম্ভব হবে, যেহেতু এটা ফেসবুকেরই তৈরি। এছাড়া আপনার লোকাল কারেন্সিতে ক্যাশ আউটও করতে পারবেন। শুধুমাত্র একটাই পার্থক্য, জাস্ট লিব্রা টাকা বা ডলার নয়, বরং অন্য একটি কারেন্সি। আর হ্যা, এটি মুলত একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি হওয়ায়, অন্যান্য ডিজিটাল ই-ওয়ালেটের মতো ক্যাশ ইন করতে বা আউট করতে হাই ক্রেডিট কার্ড চার্জ বা ব্যাংক চার্জ বা এই ধরনের কোন ক্যাশ ইন চার্জ বহন করতে হবে না ইউজারকে। আর যদি কোন ফি-ও বহন করতে হয়, তবে তা হবে খুবই সামান্য।
লিব্রা কিভাবে কাজ করে?
লিব্রা জিনিসটি আপনার বা ইউজারদের এন্ড থেকে কিভাবে কাজ করবে সেটা ওপরেই বলেছি। আর একজন অ্যাভারেজ ইউজার যারা শুধুমাত্র লিব্রা কয়েক সেন্ড,রিসিভ বা পে করবেন, তাদের এতকিছু জানার দরকারও হবেনা। তবে আপনার যদি আরও বেশি কৌতূহল থাকে, তাহলে আরও কিছু বকবক করি এটা নিয়ে। প্রথমত, লিব্রা যেহেতু একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি, তাই ধারনা করতেই পারছেন যে, এটিও ব্লকচেইন টেকনোলজির ওপরে ভিত্তি করেই কাজ করবে।
আর ব্লকচেইন, ক্রিপ্টোকারেন্সি এসব নাম শুনলেই মাথায় এমনিতেই রিস্ক এর ব্যাপারটা চলে আসে। কারন, ক্রিপ্টোকারেন্সির ভ্যালু রাতারাতি অনেক বেড়ে যেতে পারে আবার একদিনের মধ্যেই আবার কমে মাটিতে নেমে যেতে পারে। তাহলে তো এটি কিছুতেই একটি আইডিয়াল গ্লোবাল কারেন্সি হতে পারে না। কিন্তু না, এই কয়েনকে এমনভাবে কোড করা হয়েছে যাতে এটির প্রাইস ফিয়াট কারেন্সি যেমন ডলার,রুপি, টাকার মতো স্ট্যাবল থাকে। তাই রাতারাতি লিব্রা কয়েনের প্রাইস অনেক বেড়ে যাওয়া আবার অনেক কমে যাওয়ার কোন ভয় থাকবে না এই কয়েনের ক্ষেত্রে যে ধরনের নিশ্চয়তা বিটকয়েন তথা বর্তমানে মার্কেটের কোন ক্রিপ্টোকারেন্সির ক্ষেত্রেই নেই।
অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সির মতোই লিব্রা কয়েনেরও আলাদা ব্লকচেইন আছে এবং লিব্রা কয়েনের প্রত্যেকটি ট্রানজ্যাকশন ব্লকচেইনে সেভ করা হবে এবং কোন ডাটা কখনোই মুছে ফেলা সম্ভব হবে না। আর হ্যা, অন্য সব ক্রিপ্টোকারেন্সির মতোই এই কয়েনের ট্রানজ্যাকশনগুলোও হবে পাবলিক এবং যেকেউ এই ট্রানজ্যাকশন দেখতে পাবে। কিন্তু ভয়ের কিছু নেই, কারন এখানে কেউ ইউজারের নাম বা ফেসবুক আইডি কখনোই দেখতে পাবে না। তাই ইউজারের প্রাইভেসি রক্ষার স্বার্থে ফেসবুক এমনকি নিজে এই লিব্রা কয়েন রিলেটেড কোন ডাটা প্রোসেসও করবে না। লিব্রা কয়েন সম্পর্কিত সব ধরনের কাজের জন্য ফেসবুক একটি নতুন অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করেছে যার নাম ক্যালিব্রা অ্যাসোসিয়েশন।
ব্লকচেইন সম্পর্কে আইডিয়া থাকলে আপনি জানেন যে, ব্লকচেইনে আসা প্রত্যেকটি ট্রানজ্যাকশন ভেরিফাই করার দরকার পড়ে। লিব্রা কয়েনের ক্ষেত্রে লিব্রা ব্লকচেইন প্রতি সেকেন্ডে ১০০০ টি লিব্রা ট্রানজ্যাকশন প্রোসেস করবে তাই লিব্রার ট্রানজ্যাকশন বিটকয়েন বা অন্যান্য যেকোনো ক্রিপ্টোকারেন্সির থেকে অনেক বেশি ফাস্ট হবে। ফাস্ট বলতে একেবারে ইনস্ট্যান্টই হবে বলা যায়। আর এই ট্রানজ্যাকশন ভেরিফাই করার কাজটি করবে ক্যালিব্রা অ্যাসোসিয়েশনের ২৩ টি পার্টনার/ মেম্বার ইন্ডাসট্রি, যারা প্রত্যেকে মিনিমামা ১০ মিলিয়ন ডলার করে ইনভেস্ট করেছে শুধুমাত্র ক্যালিব্রা অ্যাসোসিয়েশনের মেম্বারশিপ পাওয়ার জন্য। তবে আগামী বছর লিব্রা কারেন্সি লঞ্চ হওয়া পর্যন্ত এই মেম্বার সংখ্যা ১০০ হবে বলে আশা করে ফেসবুক। আর লিব্রা কয়েনের পরবর্তী যেকোনো ডিসিশন নেওয়ার ক্ষেত্রে এই ২৩ টি ইন্ডাস্ট্রি ১ টি করে ভোট দেওয়ারও সুযোগ পাবে।
মেজর ক্রেডিট কার্ড কোম্পানি ভিসা এবং মাস্টারকার্ড থেকে শুরু করে, মিউজিক স্ট্রিমিং কোম্পানি স্পোটিফাই, রাইড শেয়ারিং সার্ভিস উবার, লিফট, পৃথিবীর সবথেকে বড় ই-ওয়ালেট পেপ্যাল পর্যন্ত এবং আরও অনেক জনপ্রিয় কমার্শিয়াল এবং নন-প্রোফিট টেক ইন্ডাসট্রি পার্টনার আপ করেছে ক্যালিব্রা অ্যাসোসিয়েশনের সাথে। তাই এই কয়েন লঞ্চ হওয়ার প্রথম দিন থেকেই এসব কোম্পানি লিব্রা কয়েনকে তাদের আরেকটি পেমেন্ট মেথড হিসেবে অ্যাক্সেপ্ট করার পরিকল্পনা রেখেছে। তাই এতক্ষনে ধারনা করতেই পারছেন যে, লিব্রা কয়েন কিভাবে এবং কি কি কারনে বিটকয়েন বা অন্যান্য যেকোনো ক্রিপ্টোকারেন্সির থেকে আলাদা।
এখন আপনি ভাবতে পারেন যে, এসব পার্টনার কোম্পানিগুলোর কি লাভ একটি নন প্রোফিট অরগানাইজেশন ১০ মিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করে? অবশ্যই প্রোফিট পাবে বলেই ইনভেস্ট করেছে এবং মেম্বারশিপ নিয়েছে। লিব্রা ওয়ালেটে যেসব মানি ক্যাশ ইন করানো হবে সেগুলো অবশ্যই ক্যালিব্রা অ্যাসোসিয়েশনের নির্দিষ্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্টোর করে রাখা হবে। আর বিপুল পরিমান অর্থ জমা হলে সেখান থেকে অবশ্যই বেশ মোটা অংকের প্রোফিট/ ইন্টারেস্ট জেনারেট হবে। এই ইন্টারেস্টের নির্দিষ্ট শতাংশ পাবে এই পার্টনার কোম্পানিগুলো তাদের ইনভেস্টমেন্ট অনুযায়ী। আর এত বড় একটি প্রোজেক্ট থেকে বেশ ভালো প্রোফিট জেনারেট হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলেই প্রত্যেকটি কোম্পানি মিনিমাম ১০ মিলিয়ন ডলার করে ইনভেস্ট করেছে ক্যালিব্রা অ্যাসোসিয়েশনে।
ক্যালিব্রা অ্যাসোসিয়েশনের লক্ষ্য
ফেসবুকের এই লিব্রা অ্যাসোসিয়েশনের প্রোজেক্টটি যদি সফল হয় এবং মানুষ পেপ্যালের মতো এটিকে মেইনস্ট্রিম মানি ট্রান্সফার সল্যুশন হিসেবে ব্যাবহার করতে শুরু করে, তাহলে লিব্রা কয়েনের সাহায্যে সবথেকে বেশি উপকৃত হবে প্রায় ১.৭ বিলিয়ন তুলনামুলকভাবে দরিদ্র সম্প্রদায় এর মানুষ যাদের কোন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই এবং প্রিয়জনদের কাছে অর্থ পাঠানোর ডিজিটাল সল্যুশনস যেমন মানিগ্রাম, ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন ইত্যাদি অন্যান্য ব্যায়বহুল মাধ্যমে মানি ট্রান্সফার করতে হলেও তাদেরকে বেশ ভালো পরিমান ফি গুনতে হয় যা তাদের অর্থের প্রায় ৭% ও হয়ে থাকে। তাদের পক্ষে এত বেশি ফি দিয়ে মানি ট্রান্সফার করা খুবই কষ্টকর। তবুও তাদেরকে করতে হয় যেহেতু তাদের কাছে অন্য কোন অপশন নেই।
লিব্রা অ্যাসোসিয়েশনের মতো একটি ফ্রি মানি ট্রান্সফার সার্ভিস তথা সহজ একটি অনলাইন ই-ওয়ালেট তাদের জন্য অনেক বেশি ইউজফুল হতে পারে। আর যেহেতু শুধুমাত্র ফেসবুক অ্যাকাউন্টের সাহায্যেই লিব্রা কয়েনের সব ধরনের ফিচার ব্যাবহার করা সম্ভব হয়, তাই এটি কম টেকনিক্যাল জ্ঞান সম্পন্ন মানুষের জন্য একটি সহজ এবং ঝামেলাহীন সল্যুশন হতে চলেছে।
এই ছিলো ফেসবুকের নতুন লিব্রা কয়েন এবং ক্যালিব্রা অ্যাসোসিয়েশন। তবে একটা স্পয়লার আগে থেকেই বলে দিই, বাংলাদেশ যেহেতু অফিসিয়ালি ক্রিপটোকারেন্সি সাপোর্ট করে না, তাই লিব্রা কয়েন বাংলাদেশে অফিসিয়ালি লঞ্চ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। নতুন কারেন্সি তৈরির লক্ষ্যে ফেসবুকের এই নতুন ইনিশিয়েটিভ নিয়ে আপনার মতামত কি? চাইলে কমেন্ট সেকশনে জানাতে পারেন। এছাড়া অন্য কোন প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলেও কমেন্ট সেকশনে জানাতে ভুলবেন না।
Image Credit: Shutterstock