পিং কি? ইন্টারনেটে ব্যান্ডউইথ স্পীডই কি সবকিছু?

আপনার আইএসপি বা ব্রডব্যান্ড কোম্পানি আপনার কাছে প্রত্যেক সেকেন্ডে প্রতি কিলোবিট বা মেগাবিট স্পীড আকারে ইন্টারনেট বিক্রি করে। কোন ইন্টারনেট কানেকশনে কেবিপিএস বা এমবিপিএস বাদেও আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্ম রয়েছে, আর তা হলো পিং বা লেটেন্সি। আসলে “পিং” হলো একটি পরিমাপ করার স্ট্যান্ডার্ড, যা এটা পরিমাপ করতে সাহায্য করে যে, আপনার ক্লায়েন্ট ডিভাইজ (ল্যাপটপ, ডেক্সটপ, ট্যাবলেট, মোবাইল) থেকে ইন্টারনেট সার্ভারে সংযুক্ত হতে আপনার কতটা সময় লাগছে। আবার পিংকে কেবল একটি কম্যান্ড লাইন ও বলতে পারেন, যা প্রত্যেকটি প্রধান অপারেটিং সিস্টেমে রয়েছে। যেমন উইন্ডোজ পিসি তে কম্যান্ড প্রমট ওপেন করে “পিং” টেস্ট করতে পারেন।

আপনি ইন্টারনেটে যাই করুন না কেন—কোন ফাইল ডাউনলোড করুন, অনলাইন গেমিং করুন, ওয়্যারবিডি থেকে আর্টিকেল পড়ুন, আপনার ব্রাউজারের প্রত্যেকটি ক্লিকে আপনাকে পিঙ্গের সাথে মুখোমুখী হতে হবে। কোন ওয়েব সার্ভারের সাথে দ্রুত কানেক্ট হতে অবশ্যই কম পিং রেটের গুরুত্ব সবচাইতে বেশি, এতে কতো কেবিপিএস বা এমবিপিএস কানেকশান ব্যবহার করছেন তাতে কোন যায় আসে না, তবে একবার সার্ভারের সাথে কানেক্ট হয়ে গেলে, সার্ভার থেকে প্যাকেট গুলো (ইমেজ, টেক্সট, কোড) দ্রুত আপনার ডিভাইজ পর্যন্ত পৌঁছাতে কেবিপিএস বা এমবিপিএস এর ভূমিকা রয়েছে। তো চলুন, আজকের বিষয়টি থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গুলো আরোহণ করার চেষ্টা করি।

পিং কোথায় ব্যবহৃত হয়?

“পিং” মানে যে শুধু দুটি কম্পিউটারের মাঝে কানেক্ট হওয়ার সময় তাই না, এটি পরিমাপ করে একটি কম্পিউটার থেকে আরেকটি কম্পিউটারে প্রত্যেকটি প্যাকেট কতো সময়ে রিসিভ হয়। প্যাকেট সম্পর্কে না জানলে ইন্টারনেট কীভাবে কাজ করে আর্টিকেলটি পড়তে পারেন। আপনি হয়তো লক্ষ্য করে দেখেছেন, আপনি যখন কোন ওয়েবসাইটে ক্লিক করেন ওপেন করার জন্য, এটি কিন্তু সাথেসাথে লোড নেয় না, আবার ওয়েবসাইটটি একবার খোলার পড়ে যখন অন্য কোন পেজে ক্লিক করেন তখনও এটি কিছু সময় নেয়, আর এটাই হলো লেটেন্সি।

চলুন ব্যাপারটাকে আরেকটু পরিষ্কার করার জন্য একটি উদাহরণ নেওয়া যাক, মনে করুন আপনি একটি পানির পাম্পের মুখে একটি নল লাগালেন, আপনার বাগানের গাছে পানি দেওয়ার জন্য। আপনি যখন পাম্পটি স্টার্ট করবেন তখন সাথেসাথে কিন্তু পানি নলের আরেক প্রান্ত দিয়ে পড়তে শুরু করবে না, প্রথমে নলটি আগে পানি দ্বারা পরিপূর্ণ হবে এবং পরে আরেকদিন দিয়ে পানি পড়তে শুরু করবে। তো পাম্পের মুখ থেকে নলের আরেক প্রান্ত পর্যন্ত পানি আসতে যে দেরি লাগলো সেটিই হলো লেটেন্সি। আর দুটি কম্পিউটারের মধ্যের সংযুক্ত হওয়ার এই লেটেন্সিকেই পিং পরিমাপ করে। অনেকে “পিং” এবং লেটেন্সিকে একই মনে করে, আসলে দুইটি জিনিষ একই হলেও তা এক নয়। “পিং” হলো লেটেন্সি পরিমাপ করার একটি ম্যাপ এবং “লেটেন্সি” হলো সার্ভার এবং ক্লায়েন্টের মাঝে সংযুক্ত হওয়ার সময়।

পিং-রেট কতটা গুরুত্বপূর্ণ

আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, কোন সার্ভারের সাথে বা কোন ওয়েব সাইটের সাথে দ্রুত কানেক্ট হওয়ার জন্য পিঙ্গের গুরুত্ব সবচাইতে বেশি। মনেকরুন আপনার অফিসের ইন্টারনেট স্পীড ২০এমবিপিএস, কিন্তু ঐ কানেকশনের পিং-রেট ২০০এমএস (মিলি-সেকেন্ড)। আবার ধরুন আপনার বাসার ইন্টারনেট স্পীড ১০এমবিপিএস কিন্তু এই কানেকশনের পিং-রেট ২০এমএস, তাহলে কোনটা উত্তম? আসলে পিং-রেট বা ব্যান্ডউইথ স্পীডের উপর নির্ভর করে এই প্রশ্নের সঠিক উত্তরটি দেওয়া সম্ভব নয়। এটি নির্ভর করবে, আপনি ইন্টারনেট কানেকশনটি দিয়ে কি করছেন, তার উপরে।

যদি আপনি অনলাইন গেমিং করেন, তবে সেখানে কম পিং-রেটের গুরুত্ব অনেক বেশি, এখানে শুধু ব্যান্ডউইথ স্পীড থাকলেই হবে না। আপনার পিং-রেট যদি অনেক বেশি হয়, তবে গেমে আপনার প্রদানকৃত ইনপুট গেম সার্ভারটির কাছে পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। ফলে দেখা যাবে কোন অ্যাকশন গেমে আপনি গুলি করেছেন কিন্তু তার আগে আপনাকেই কেউ গুলি মেরে দিয়েছে, আপনি হয়তো ঠিক সময়েই গুলি করেছিলেন, কিন্তু আপনার কম্যান্ডটি সার্ভারের কাছে পৌঁছাতে গিয়ে দেরি হয়ে গেছে—কেনোনা আপনার লেটেন্সি বা পিং-রেট অনেক বেশি। আর এই জন্য অনলাইন গেম বা মাল্টিপ্লেয়ার গেম গুলোতে স্ক্রীনে পিং-রেট বা লেটেন্সি শো করে।

আবার অন্যদিকে আপনি যদি একজন সাধারন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী হোন, মানে সাধারন ইন্টারনেট ব্রাউজিং, ডাউনলোড, ভিডিও স্ট্রিম করার জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করেন তবে পিং-রেটের চাইতে আপনার প্রয়োজন পড়বে বেশি ব্যান্ডউইথ স্পীড। আপনার পিং বেশি হলে হয়তো প্রত্যেকটি পেজ আসতে একটু দেরি হবে, যদিও লোড নিতে দেরি হবে না, কিন্তু আপনি যখন কোন ফাইল ডাউনলোড করবেন বা ইউটিউব ভিডিও প্লে করবেন তখন ব্যান্ডউইথ স্পীডই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হবে। বেশি পিং-রেটে প্যাকেট গুলোর সাথে কানেক্ট হতে একটু সময় লাগতে পারে, কিন্তু একবার কানেক্ট হয়ে গেলে তা দ্রুত আপনার কম্পিউটারে পৌঁছাতে ব্যান্ডউইথ স্পীড কাজ করবে। তবে এখানেও একটি ব্যাপার রয়েছে, মনেকরুন আপনি একসাথে ব্রাউজারে অনেক গুলো পেজ ওপেন করে রেখেছেন, এবং কিছু কিছু পেজ ব্যাকগ্রাউন্ডে রিফ্রেস হচ্ছে তবে এই কাজটি করতে আপনার কম্পিউটারকে একসাথে বহুত ইঙ্কামিং এবং আউটগোয়িং ট্র্যাফিকের সাথে কাজ করতে হচ্ছে, এখন এখানে যদি লেটেন্সি বেশি থাকে তবে ঠিক মতো ওয়েব ব্রাউজ করতেই পারবেন না।এখানে পিং-রেটের গুরুত্ব বেশি।

পিং কীভাবে কাজ করে?

এটি অনেক সাধারন একটি টার্মের উপর কাজ করে, নিচে এর কাজ করার পদ্ধতিটি দেওয়া হলো;

  • আপনার কম্পিউটার, সার্ভার কম্পিউটারের কাছে কোন কিছু চেয়ে ছোট্ট পরিমানের ডাটা সেন্ড করে।
  • সার্ভার কম্পিউটার সেই অনুরোধটি গ্রহন করে, এবং যাচায় করে দেখে তার কাছে কি রিপ্লাই চাওয়া হয়েছে এবং এটি পাওয়ার জন্য তার যোগ্যতা আছে কিনা।
  • এবার সবকিছু ঠিক থাকলে সার্ভার কম্পিউটারটি আপনার কাছে আবার প্রয়োজনীয় প্যাকেট গুলো পাঠিয়ে দেয়।

আসলে উপরের পদ্ধতিতে একএকটি সিঙ্গেল পিং কাজ করে, এটিকে আপনি নিজেও চেক করে দেখতে পারেন। আপনার উইন্ডোজ পিসির কম্যান্ড প্রমট ওপেন করে টাইপ করুন “ping archive.wirebd.com” (কমা বাদে), তাহলে দেখবেন।

Pinging archive.wirebd.com [74.208.236.97] with 32 bytes of data:
Reply from 74.208.236.97: bytes=32 time=778ms TTL=42
Reply from 74.208.236.97: bytes=32 time=739ms TTL=42
Reply from 74.208.236.97: bytes=32 time=593ms TTL=42
Reply from 74.208.236.97: bytes=32 time=718ms TTL=42

উপরের মতো ডাটা আপনার কম্যান্ড প্রমটে প্রদর্শিত হচ্ছে। এখানে আপনার ক্লায়েন্ট কম্পিউটার প্রথমে ডোমেইনটির সাথের আইপি অ্যাড্রেসটিকে খুঁজে বের করছে এবং ঐ সার্ভার কম্পিউটারের কাছে একটি ৩২ বাইটের রিকোয়েস্ট প্যাকেট পাঠিয়েছে। তারপরে দেখুন আপনার কম্পিউটার, সার্ভার থেকে কিছু প্যাকেট রিসিভ করছে, এবং “time=778ms” এই সময় গুলোই হলো লেটেন্সি বা পিং-রেট।

পিং-রেট কম বেশি কেন হয়?

বিভিন্ন আইএসপি বা বিভিন্ন সার্ভারের পিং-রেট বা রেসপন্স টাইম বা লেটেন্সি কম বেশি হওয়ার উপরে অনেক গুলো বিষয় নির্ভর করে। আপনি যে ওয়েব সার্ভার থেকে প্যাকেট রিসিভ করতে চাচ্ছেন, সেই সার্ভার যদি অনেক দূরে থাকে তবে পিং-রেট বেড়ে যেতে পারে। আবার সার্ভার এবং আপনার কম্পিউটারের মাঝের কানেকশনে যেমন ফাইবার অপটিক ক্যাবল যদি খারাপ হয়, তবেও পিং-রেট বেড়ে যেতে পারে। আপনার ব্রডব্যান্ড কানেকশনের পিং-রেট ১এমএস হলেই যে আপনি যেকোনো সার্ভারের সাথে ১এমএস পিং-রেটেই কানেক্ট হতে পারবেন, এমনটা কিন্তু নয়। যদি সার্ভারের পিং-রেট বেশি হয় বা সার্ভারটি অনেক দূরে থাকে তবে আপনার ১মএস পিং-রেট হয়েও লাভ নেয়। দেখুন নিচে একটি প্রমান দেওয়ার চেষ্টা করছি।

কিন্তু দেখুন আমি যখন ঐ একই সার্ভার থেকে এই সাইটের সার্ভারের সাথে কানেক্ট হওয়ার রিকোয়েস্ট করলাম, তখন ওয়্যারবিডি সার্ভার থেকে ডাটা ফেরত আসতে সময় লাগলো ১০৩ মিলিসেকেন্ড। অর্থাৎ এখানে এটাই প্রমানিত হলো যে, আপনার পিং-রেট কম হলেই যে শুধু হবে তা না, সাথে আপনার সংযুক্ত হওয়া সার্ভারেরও পিং-রেট, কানেকশন, দূরত্ব ঠিকঠাক থাকা চাই। তবে আপনার পিং-রেট তো কম হওয়া চাই ই চাই। আশা করছি ব্যাপারটা বোঝাতে পেরেছি।

জিরো পিং-রেট কি সম্ভব?

এক কথায় উত্তর দিতে গেলে জিরো পিং-রেট কখনোয় সম্ভব নয়। পদার্থ বিজ্ঞান অনুসারে যেমন প্রত্যেকটি বস্তু কোথাও থেকে আসতে কোন নির্দিষ্ট সময় লাগে ঠিক তেমনি ডাটা প্যাকেট গুলোকেও এক কম্পিউটার থেকে আরেক কম্পিউটার পর্যন্ত আসতে কিছু সময় লাগবে। আপনার সার্ভারটি যতো কাছেই হোক না কেন এমনকি আপনার হোম সার্ভার বা আপনার লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্কে থাকা কোন কম্পিউটারকে পিং করলেও সেটি থেকে জবাব আসতে ১-২ মিলিসেকেন্ড লেগে যাবে।

আপনি যতো উন্নত ফাইবার অপটিক ক্যাবলই ব্যবহার করুন না কেন সেটি দিয়েও ডাটা প্যাকেট আলোর গতির চাইতে বেশি দ্রুত আসতে পারবে না। তবে আপনার নিজের কম্পিউটারে ping localhost কম্যান্ড ব্যবহার করে নিজে থেকে পিং করলে পিং-রেট জিরো দেখায়। তবে ব্যস্তবিকভাবে এটিও সত্য নয়—কেনোনা আপনার কম্যান্ডটি প্রসেস করতে কম্পিউটারের সফটওয়্যারের কিছু সময় লেগেছে, যদিও সেই সময় অতি সামান্য তবেও সেটি জিরো হতে পারে না।

তাই বলা যেতে পারে, ব্যস্তবিকভাবে, বৈজ্ঞানিক ভাবে, বা তাত্ত্বিকভাবে কোন ভাবেই জিরো পিং-রেট সম্ভব নয়। তবে ভবিষ্যতে আমরা নেটওয়ার্ক লেটেন্সি অনেক কমিয়ে এনে আরো ভালো এবং উপযুক্ত ইন্টারনেট তৈরি করতে পারবো এতে কোন সন্দেহ নেই।

শেষ কথা

তো এই ছিল আজকের পোস্ট, জানি হয়তো কিছু বিষয় একটু ট্যাঁরা প্রকৃতির ছিল, তারপরেও হয়তো আমি সফলভাবে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি।  এখন থেকে আপনি নিশ্চয় জানলেন যে, আপনার বেশি ব্যান্ডউইথ স্পীড প্রয়োজন না, কম পিং-রেট প্রয়োজন। তো আপনার ইন্টারনেট লাইনের ব্যান্ডউইথ স্পীড বা পিং-রেট কতো এবং এর সাথে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন, নিচে আমাদের কমেন্ট করে জানান।

/Image Credit: Shutterstock

About the author

তাহমিদ বোরহান

আমি তাহমিদ বোরহান, বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন প্রযুক্তি ব্লগার হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে বাংলায় টেক কন্টেন্ট এর বিশেষ অভাব রয়েছে, তাছাড়া উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট বেশিরভাগ মানুষের মাথার উপর দিয়েই যায়। ২০১৪ সালে প্রযুক্তি সহজ ভাষায় প্রকাশিত করার লক্ষ্য রেখেই ওয়্যারবিডি (পূর্বের নাম টেকহাবস) ব্লগের জন্ম হয়! আর এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আর্টিকেল প্রকাশিত করে বাঙ্গালীদের টেক লাইফ আরো সহজ করার ঠেকা নিয়ে রেখেছি!

সারাদিন প্রচুর পরিমাণে গান শুনি আর ইউটিউবে র‍্যান্ডম ভিডিও দেখি। ওয়ার্ডপ্রেস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভিডিও প্রোডাকশন, এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের উপরে বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। নিজের গল্প, মানুষের গল্প, আর এলোমেলো টপিক নিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে লিখি। খাওয়া আর ঘুম আমার আরেক প্যাশন!

Add comment

Categories