হার্ডড্রাইভ কীভাবে কাজ করে? | এক অসাধারণ ইঞ্জিনিয়ারিং

অনেক মানুষ এটা ভেবেই অবাক হয়ে যান, কীভাবে কয়েকশত সিডির জায়গার মিউজিক সামান্য হাফ ইঞ্চির সমান মেমোরি কার্ডে এঁটে যায়। আবার একটি হার্ডড্রাইভের তুলনায় একটি মেমোরি কার্ড কিছুই না। হার্ডড্রাইভ হলো একটি দক্ষ কম্পিউটার মেমোরি ডিভাইজ, যেটি সাধারন চুম্বকত্ব ব্যবহার করে অসংখ্য পরিমান ডাটা সংরক্ষন করে রাখতে পারে। আপনার কম্পিউটারে থাকা মাইক্রোপ্রসেসর, কম্পিউটারের সকল প্রসেস এবং টাস্ক সম্পূর্ণ করে থাকে—কিন্তু হার্ডড্রাইভই হলো সেই ডিভাইজ যেখানে আপনাকে অসংখ্য পরিমান ডাটা, মিউজিক, ডিজিটাল ফটোস, টেক্সট ডকুমেন্টস ইত্যাদি সংরক্ষিত করার সুযোগ প্রদান করে। এটি এক অসাধারণ আবিষ্কার যার উৎপত্তি ১৯৫০ সালের দিকে হয়েছিলো, এবং শুনতে আশ্চর্য লাগলেও এর প্রাথমিক অবস্থা ছিল ক্যাসেট টেপের রূপে।

চুম্বকত্ব দিয়ে কীভাবে তথ্য সংরক্ষন করা সম্ভব?

ম্যাগনেটিজম বা চুম্বকত্বের পেছনের বিজ্ঞান কিন্তু জটিল জিনিষ। তবে কোন লোহার টুকরার কাছে কোন চম্বুককে এনে রাখলে কি হবে—আপনি নিশ্চয় সেই প্রযুক্তিটি জানেন—চম্বুকের বিজ্ঞান জটিল হলেও এর ব্যস্তব প্রয়োগ কিন্তু অনেক সহজ। লোহার টুকরায় প্রথম অবস্থায় চুম্বকত্ব থাকে না, তবে আপনি যদি একটি চম্বুক দিয়ে কোন লোহার টুকরাকে বারবার ঘোষতে থাকেন তবে সেই লোহাটিও একসময় চম্বুকে পরিণত হবে, এবং অন্য চম্বুকের সাথে চিপকে লেগে থাকবে। তাছাড়া চম্বুকের অনেক ব্যবহারিক ব্যবহার রয়েছে, যেমন— আবর্জনা সরানোর জন্য ইলেক্ট্রোম্যাগনেট (এটি একটি কৃত্তিম চম্বুক বা ইলেক্ট্রিসিটি ব্যবহার করে অন বা অফ করানো যায়) ব্যবহার করা হয়, এতে বড় বড় ধাতব নল বা ভাঙ্গা গাড়ি সরানো হয়।

আবর্জনা সরানো ছাড়াও চম্বুকের আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার রয়েছে। মনেকরুন আপনি আপনার বন্ধুকে একটি ম্যাসেজ পাঠাতে চান, কিন্তু ম্যাসেজ পাঠানোর জন্য আপনার কাছে রয়েছে একটি চুম্বকত্ব লোহা এবং আরেকটি অচুম্বক লোহা। এখন মনেকরুন, আপনার ম্যাসেজটি অনেক সাধারন, মানে আপনি তার সাথে দেখা করতে পারবেন কিনা, শুধু হ্যাঁ বা না তে ম্যাসেজ করতে চান। তো আপনি আপনার বন্ধুর বাড়িতে কাওকে দিয়ে একটি লোহার টুকরা পাঠালেন, সে টুকরাটি তার পেপার ক্লিপের সাথে লাগিয়ে দেখবে, যদি এটি পেপার ক্লিপটিকে আকর্ষণ করে তবে এটি চুম্বকত্ব লোহা, মানে আপনি দেখা করতে আসছেন, আর যদি না করে তবে আপনি দেখা করতে পারবেন না। আমি জানি, ম্যাসেজ পাঠানোর জন্য এটি অদ্ভুদ এক উদাহরণ হয়ে গেলো—কিন্তু একটু ভেবে দেখুন, এই উদাহরনের ফলে একটি জিনিষ সামনে আসলো, আর তা হলো—চম্বুক কোন তথ্যকে সংরক্ষিত করে রাখতে পারে।

যদি আপনার কম্পিউটারে ২০ গিগাবাইটের (GB) হার্ডড্রাইভ থাকে, তবে মনে করতে হবে এটি এমন একটি বাক্স যেখানে ১৬০ হাজার মিলিয়ন মাইক্রোসকপিক চুম্বকত্ব লোহার টুকরা রয়েছে এবং প্রত্যেকটি টুকরা আপনার তথ্যের অতি ক্ষুদ্র অংশ বা বিট ধারণ করছে। বিট সম্পর্কে আমি আগের পোস্ট গুলোতে অনেক ধারণা দিয়েছি, এটি মূলত বাইনারি ডিজিট যেখানে শুধু ১ বা ০ সংখ্যা হিসেবে থাকে। কম্পিউটারে কোন সংখ্যা দশমিক বা ডেসিম্যাল (০-১০) আকারে থাকে না, বরং বাইনারি সংখ্যার প্যাটার্নে থাকে। যেমন ডেসিম্যাল নাম্বার ৩৮২ বাইনারি রূপে থাকে ১০১১১১১১০ আকারে—এভাবে কোন অক্ষর গুলোও বাইনারি আকারে থাকে। যেমন- কম্পিউটার ইংরেজি বড় হাতের অক্ষর “A” যার ডেসিম্যাল নাম্বার “৬৫” কে সংরক্ষিত করে বাইনারি নাম্বার “১০০০০০১” রূপে। এখন মনেকরুন আপনি আপনার কম্পিউটার হার্ডড্রাইভে “১০০০০০১” নাম্বারটি সংরক্ষিত করতে চান, যেখানে চম্বুকের সাহায্য নিয়ে আপনাকে কাজটি করতে হবে। তবে সেখানে আপনাকে একটি সাড়ি খুঁজে বের করতে হবে যেখানে একসাথে ৭টি অব্যবহৃত লোহার টুকরা রয়েছে। এখন আপনি প্রথম টুকরাটিকে চুম্বকত্ব দিলেন (যা ১ সংরক্ষিত করলো) এবং পরের ৫টি টুকরাকে অচম্বুক (যা পাঁচটি ০ সংরক্ষিত করলো) অবস্থায় রেখে দিলেন, এবং শেষেরটিকে চুম্বকত্ব দিলেন (যা ১ সংরক্ষিত করলো)। এভাবেই আপনি সহজেই ডাটা সংরক্ষিত করতে পারবেন।

হার্ডড্রাইভ বা হার্ডডিস্ক কীভাবে কাজ করে?

আপনার কম্পিউটার হার্ডড্রাইভে প্রকৃতপক্ষে কোন লোহার টুকরা থাকে না, সেখানে একটি চকচকে বৃত্তাকার ম্যাগনেটিক ধাতুর প্লেট থাকে যাকে “প্লেটার” বলা হয়—আর এর মধ্যে বিলিয়ন বিলিয়ন ক্ষুদ্রক্ষুদ্র এরিয়া থাকে। এর প্রত্যেকটি এরিয়া স্বাধীনভাবে চুম্বকত্ব (১ সংরক্ষন করে) পেতে পারে আবার অচম্বুক (০ সংরক্ষন করে) থাকতে পারে। কম্পিউটার ফ্ল্যাশ মেমোরির সমস্যা হলো, এতে বিদ্যুৎ প্রবাহ বন্ধ করা হলে এটি সকল তথ্য ভুলে যায় (যেমন- র‍্যাম), তাই তথ্য সংরক্ষিত করার জন্য হার্ডড্রাইভ এ চম্বুক শক্তি ব্যবহার করা হয়, যাতে কম্পিউটার বন্ধ থাকেও এটি তথ্য গুলোকে ধারণ করে রাখতে পারে।

প্লেটার হলো হার্ডড্রাইভ এর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। এর নাম অনুসারে, এটি একটি ডিস্ক যা কঠিন পদার্থ গ্লাস বা অ্যালুমিনিয়ামের সমন্বয়ে গঠিত হয়ে থাকে, যেখানে এমন এক ধাতুর পাতলা আস্তরণ দিয়ে লেপে দেওয়া থাকে যা যেকোনো সময় চম্বুক বা অচম্বুক হতে পারে। ছোট হার্ডড্রাইভ গুলোতে শুধু মাত্র একটি প্লেটার থাকে, যার উভয় পৃষ্ঠেই ম্যাগনেটিক মেটাল দ্বারা লেপে দেওয়া থাকে। বড় আকারের হার্ডড্রাইভে প্লেটারের একটি সিরিজ থাকে, এই প্লেটারটি প্রতি মিনিটে ১০,০০০ বার পর্যন্ত আবর্তিত হতে পারে, (একে আরপিএম বলে) যাতে ডাটা রীড-রাইট হেড যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো অংশ অ্যাক্সেস করতে পারে।

প্রত্যেকটি প্লেটারে দুইটি রীড-রাইট হেড থাকে, একটি উপরিতলকে রীড করে এবং আরেকটি নিচেরতলকে রীড করে—অর্থাৎ যে হার্ডড্রাইভে পাঁচটি প্লেটার রয়েছে সেখানে দশটি হেড থাকা প্রয়োজনীয়। হেডারটি যেকোনো সময় প্লেটারটির যেকোনো অবস্থানে চলে যেতে পারে, তবে হেডার এবং প্লেটার কখনোয় একদম ঘিসে লেগে থাকে না, এদের মাঝে হয় কোন তরল বা বাতাস থাকে।

ডাটা রীড এন্ড রাইট

কম্পিউটার হার্ডড্রাইভ এর সবচাইতে ভালো বিষয় শুধু এটা নয় যে এটি কোন ডাটা সংরক্ষন করে রাখতে পারে, বরং আপনি সেই ডাটা গুলোকেও পরেও অ্যাক্সেস করতে পারেন। কম্পিউটার হার্ডড্রাইভে কোন আলাদা আলাদা চৌম্বুক লোহা থাকে না, এতে সবগুলো একসাথে মিশে থাকে। প্রত্যেকটি তথ্যের বিট একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্নে সাজানো থাকে, এবং এই প্যাটার্ন গুলো দিয়ে একটি গোলাকার পথ তৈরি হয় যাকে ট্র্যাক বলা হয়। প্রত্যেকটি ট্র্যাকে ক্ষুদ্রতর অংশ থাকে, যাকে সেক্টর বলা হয়। কোন সেক্টর গুলো ব্যবহার করা হয়েছে এবং কোন গুলো এখনো ফাঁকা রয়েছে তা নির্ধারণ করার জন্য হার্ডড্রাইভের কাছে একটি ম্যাপ থাকে। উইন্ডোজ কম্পিউটারে এই ম্যাপকে ফাইল অ্যালোকেশন টেবিল বা এফএটি (FAT) বলা হয়।

যখন আপনার কম্পিউটার কোন নতুন তথ্য সংরক্ষিত করতে চায়, তখন এটি ম্যাপ থেকে ফাঁকা সেক্টর গুলো খোঁজে বের করে। তারপর সেই সেক্টরে ডাটা রীড-রাইট হেডকে পৌছিয়ে দেয়, এবং রাইট করার কম্যান্ড দিয়ে দেওয়া হয়। ডাটা রীড করার জন্য ঠিক রাইট করার উল্টা প্রসেস খাটানো হয়। এতো ছোট জায়গার মধ্যে এতো বিশাল পরিমানের তথ্য ধারণ করার ক্ষমতা রাখার জন্য হার্ডড্রাইভ কে সত্যিই এক অসাধারণ ইঞ্জিনিয়ারিং বলা চলে। এটি একসাথে কয়েকশত সিডির মিউজিককে একটি ছোট বাক্সে সংরক্ষিত করার সুবিধা প্রদান করে, তবে এর কিছু অসুবিধাও রয়েছে। যেমন— এর প্লেটারে একটি ক্ষুদ্র বালুকণা পড়লেও এটি অকেজো হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া এটি যেহেতু একটি ম্যাকানিক্যাল ডিভাইজ তাই এটির হেড চলতে চলতে কোন কারণে অকেজো হয়ে যেতে পারে, একে ডিস্ক ক্র্যাশ বা হেড ক্র্যাশ বলা হয়, আর এর ফলে আপনি হার্ডড্রাইভে থাকা সকল তথ্য হারিয়ে ফেলতে পারেন। তবে সমস্যা নেই, হারানো ডাটা আবার কীভাবে ফেরত পেতে পারেন তার উপরে আমার বিস্তারিত একটি পোস্ট রয়েছে।

যাইহোক, তবে হার্ডড্রাইভ ক্র্যাশ থেকে ডাটা লস হওয়া থেকে বাঁচতে গুরুত্বপূর্ণ ডাটা গুলোকে ব্যাকআপ আকারে অন্যকোন হার্ডড্রাইভে বা কমপ্যাক্ট ডিস্ক সিডি অথবা ডিভিডিতে রাখা প্রয়োজনীয়। আমি সিডি বা ডিভিডি কীভাবে কাজ করে এনিয়ে পরে একটি বিস্তারিত পোস্ট লিখে ফেলবো।

কাজের সময়

তো আপনি যখন কোন ফাইল ওপেন করেন কিংবা কম্পিউটারে যেকোনো কাজ করেন, তখন প্রত্যেকটি ডাটাকে হার্ডড্রাইভ বারবার খুঁজে বের করে দেয়। মনেকরুন। আপনি কম্পিউটারে একটি ইমেজ খুললেন, তো আপনার সিপিইউ হার্ডড্রাইভকে বলে দেবে যে ঠিক কোথায় বা কোন সেক্টরে সেটিকে খুঁজতে হবে, এবার হার্ডড্রাইভের প্লেটারটি প্রচণ্ড জোরে ঘুরতে আরম্ভ করবে এবং প্রায় ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যে ইমেজটিকে খুঁজে বের করে সিপিইউ এর কাছে পাঠিয়ে দেবে। আর একেই ডাটা রীড করা বলা হয়। সিপিইউ সেই ইমেজটি গ্রহন করবে এবং আপনার স্ক্রীনে সেটিকে প্রদর্শিত করানোর জন্য প্রসেসিং করবে।

এখন ইমেজটি এডিট করার কথা ভাবুন। আপনি কোন ইমেজকে যখন কোন ইমেজ এডিটিং সফটওয়্যারে ওপেন করে রাখেন তখন সেটি অলরেডি হার্ডড্রাইভে সেভ থাকে, কিন্তু যখন ইমেজটি এডিট সম্পূর্ণ করে করে নতুন করে সেভ করবেন তখন রীড-রাইট হেড আগের ইমেজটির অবস্থানে যাবে এবং এর উপরে নতুন ইমেজটির ডাটাকে ওভাররাইট করে দেবে, একে বলা হয় ডাটা রাইট প্রসেস।

শেষ কথা

আপনি নিশ্চয় এতক্ষণে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বুঝে গেছেন, কীভাবে হার্ডড্রাইভ কাজ করে। এই অসাধারণ ডিভাইজটির সম্পর্কে অসাধারণ তথ্য গুলো জানতে পেরে কতটা বিস্মিত হয়েছেন নিচে আমাদের কমেন্ট করে জানান। সাথে যেকোনো প্রশ্নের জন্যও কমেন্ট করতে পারেন।

/Image Credit: Shutterstock

About the author

তাহমিদ বোরহান

আমি তাহমিদ বোরহান, বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন প্রযুক্তি ব্লগার হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে বাংলায় টেক কন্টেন্ট এর বিশেষ অভাব রয়েছে, তাছাড়া উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট বেশিরভাগ মানুষের মাথার উপর দিয়েই যায়। ২০১৪ সালে প্রযুক্তি সহজ ভাষায় প্রকাশিত করার লক্ষ্য রেখেই ওয়্যারবিডি (পূর্বের নাম টেকহাবস) ব্লগের জন্ম হয়! আর এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আর্টিকেল প্রকাশিত করে বাঙ্গালীদের টেক লাইফ আরো সহজ করার ঠেকা নিয়ে রেখেছি!

সারাদিন প্রচুর পরিমাণে গান শুনি আর ইউটিউবে র‍্যান্ডম ভিডিও দেখি। ওয়ার্ডপ্রেস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভিডিও প্রোডাকশন, এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের উপরে বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। নিজের গল্প, মানুষের গল্প, আর এলোমেলো টপিক নিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে লিখি। খাওয়া আর ঘুম আমার আরেক প্যাশন!

Add comment

Categories