কেন ৫জি নিয়ে আপনার এতোবেশি উত্তেজিত হওয়া উচিৎ নয়?

ইয়েস ইয়েস ইয়েস, ৫জি আসছে, আমরা সবাই জানি, সমস্থ টেক দুনিয়া বর্তমানে ৫জি নিউজ কভার করতেই বিজি — কোন ফোনে ৫জি সাপোর্ট থাকছে, কোন প্রসেসর ৫জি সাপোর্টেড, কোন মোবাইল অপারেটর দ্রুত ৫জি দিচ্ছে, ৫জিতে ডাউনলোড স্পিড কতো, ব্লা ব্লা ব্লা — নানান প্রশ্নে আমরা একেবারে উত্তেজিত হয়ে রয়েছি। একটু অপেক্ষা করুণ ভাই, ৫জি টেকনোলোজি আর আমাদের বর্তমান অবস্থার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, এতো লাফালাফি করার কিছু নেই!

আমি এই আর্টিকেলে বর্ণনা করবো, কেন ৫জি নিয়ে আপনার এতোবেশি উত্তেজিত হওয়া উচিৎ নয়! — তো শুরু করা যাক…


৫জি নেটওয়ার্ক বর্তমান ৪জি নেটওয়ার্ক থেকে প্রায় ১০ গুন বেশি ফাস্ট (স্পিড অনুসারে), এর মানে নেটফ্লিক্স থেকে যে মুভি ৪জি ইউজ করে ডাউনলোড করতে ৫ মিনিট লাগে সেটা ৫জি নেটওয়ার্কে ৩০ সেকেন্ডে ডাউনলোড করা সম্ভব। শুধু স্পিড নয়, আপনার বাড়ির ব্রডব্যান্ড ও ৫জি দ্বারা সম্পূর্ণ রিপ্লেস করে ফেলা সম্ভব। সাথে নতুন এই টেকনোলোজিতে এক সাথে অনেক বেশি ডিভাইজ কানেক্টেড রাখা যাবে।

সেলফোন টাওয়ার থেকে কেবল শুধু আপনার ফোন নয়, আপনার ল্যাপটপ, পিসি, টিভি, ফ্রিজ, এক কথায় ইন্টারনেট অফ থিংস গুলোকে সহজেই কানেক্টেড রাখা যাবে। এমনকি সেলফ ড্রাইভিং কারের মধ্যেও ৫জি চিপ লাগানো থাকবে যাতে কার গুলো সরাসরি সেল টাওয়ারের সাথে কানেক্টেড থাকতে পারে। সবচাইতে বড় পার্থক্য আসবে লেটেন্সিতে, মোটামুটি কোন প্রকারের সময় নষ্ট না করে ডিভাইজ গুলো একে অপরের সাথে তথ্য আদান প্রদান করতে পারবে, যেহেতু ৫জি ইউজ করে গাড়ি গুলো পরিচালিত করা হবে সেক্ষেত্রে ১ সেকেন্ডের বেশি দেরি মানে জীবন চলে যেতে পারে।

সামনের দিনে ৫জি ব্যবহার করে ওয়্যারলেস ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ডিভাইজ গুলো জনপ্রিয়তা পেতে পারবে, তাছাড়া যতোযতো বেশি ডিভাইজ গুলো অনলাইন হতে শুরু করবে, ৫জির প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি বেড়ে যাবে। আর ৫জির আল্ট্রা ফাস্ট Gbps ইন্টারনেট তো রয়েছেই!

ওয়েল, এখন আপনি বলবেন, “ভাই যে অসাধারণ সুবিধা গুলোর কথা বললেন এগুলো শুনে কি আর কেউ উত্তেজিত না হয়ে থাকতে পারে?” — অবশ্যই উত্তেজিত হওয়া জায়েজ রয়েছে, কিন্তু ৫জির উপরের বর্ণিত অসাধারণ সকল ফিচার গুলো পেতে কিছু প্রসেস আর টেক আপগ্রেড প্রয়োজনীয়, যেটাই সবচাইতে চ্যালেঞ্জিং পার্ট এই সময়ের জন্য।

৫জি মানেই সম্পূর্ণ নতুন ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রয়োজনীয়

ট্রু ৫জি প্রদান করার জন্য আপনার সেলফোন প্রভাইডারকে তাদের নেটওয়ার্ক সিস্টেমের অনেক কিছু পরিবর্তন করতে হবে। ৩জি, বা ৪জি টেকনোলোজি হাতে ধরিয়ে দিতে তাদের নেটওয়ার্কিং সিস্টেমে তেমন পরিবর্তন আনার প্রয়োজন পরেনি, তারা আগের সেল টাওয়ার ইউজ করেই ২জি, ৩জি, ৪জি প্রোভাইড করছে। কিন্তু ৫জি সম্পূর্ণ আলাদা স্টাইলে কাজ করে।

৫জি যেহেতু আল্ট্রা হাই-স্পিড ইন্টারনেট প্রদান করতে সক্ষম, তাই মোবাইল অপারেটরদের আরো সুক্ষ রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করতে হবে। আর সায়েন্স অনুসারে রেডিও তরঙ্গদৈর্ঘ্য যতো ছোট হবে ব্যান্ডউইথ স্পিড বাড়বে কিন্তু সিগন্যাল রেঞ্জ কমে যাবে। বর্তমানে ৪জি সিগন্যালের রেঞ্জ প্রায় ১০ মাইল পর্যন্ত, কিন্তু ৫জির সিগন্যাল রেঞ্জ কেবল ১,০০০ ফিট যেটা ৪জির রেঞ্জের ২% ও নয়। এরমানে ৫জি ঠিকঠাক মতো পরিচালনা করতে অনেক সাব-টাওয়ার ইন্সটল করতে হবে। ৫জি সেল টাওয়ার নিয়ে লেখা বিস্তারিত আর্টিকেলে আরো বিস্তারিত জানতে পারবেন।

এখন কথা বলি চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার গুলো নিয়ে, দেখুন ঠিকঠাক ৫জি সার্ভিস দেওয়ার জন্য অপারেটর গুলোকে হাজারো নতুন নতুন টাওয়ার ইন্সটল করতে হবে, বাসার ছাঁদে কিংবা রাস্তার বৈদ্যুতিক ঘুঁটির সাথে এই সেল টাওয়ার গুলো হয়তো ইন্সটল করা থাকবে। যেগুলো সেটআপ করতে অপারেটর গুলোর কোটি কোটি টাকা খরচ হয়ে যাবে। এখন অপারেটর’রা ঠিক কতোটা ইনভেস্ট করবে সেটাও একটা প্রশ্নের ব্যাপার। যেখানে আমাদের দেশের অপারেটর’রা ফাকি মেরে টাকা ইনকাম করায় বেশ ওস্তাদ!

অপরদিকে ৫জির সিগন্যাল অত্যন্ত ছোট এবং মিলিমিটার রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ইউজ করার জন্য গ্রাম্য এলাকায় ৫জি নিশ্চিত করা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আবার সামান্য বড় গাছ ও ৫জির সিগন্যাল ব্লক করতে পারে, সেক্ষেত্রে বাড়ির বেশি অভ্যন্তরীণ কোন রুমে সিগন্যাল প্রবলেম বেশি দেখা যেতে পারে।

যেহেতু প্রায় প্রত্যেকটি বৈদ্যুতিক খুঁটি বা ল্যাম্প পোস্টকে ৫জি সাব-টাওয়ারে বদলানো হবে, তাই এদের নিজেদের মধ্যে কানেকশন জরুরী হবে যেটা ফাইবার অপটিক ক্যাবলে করা হতে পারে, যেটা শতশত কোটি টাকার ব্যাপার।

৫জি থেকে ক্যান্সারের গুজব

এখন আরেক কাহিনী রয়েছে, আমাদের দেশে বা বলতে গেলে পুরো দুনিয়ায় সব-জান্তাদের কোন অভাব নেই, যখনই এতোগুলো টাওয়ার ইন্সটল করা হবে, অনেক লোকাল কমিউনিটি বা সমাজ-সেবকরা বাধা হয়ে এসে দাঁড়াবেন, কেননা ৫জি থেকে ক্যান্সার ছড়ানোর এক গুজব ছড়িয়ে রয়েছে চারিদিকে।

বিশেষজ্ঞগন এখনো ৪জি বা ৫জি থেকে যে ক্যান্সার হতে পারে এই ব্যাপারে নিশ্চিত নন। তবে বাজারে অনেক প্রচলিত গুজব রয়েছে। টেকনিক্যালভাবে ৫জি’তে নন-আয়োনাইজিং রেডিয়েশন রয়েছে যেটা মানব দেহের কোনই ক্ষতি করতে পারে না, সেলফোন থেকে কি ক্যান্সার হতে পারে? — এই আর্টিকেলে আমি ব্যাপারটি নিয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা করেছি। তাছাড়া হয়তো এতোগুল নতুন এন্টেনা বা টাওয়ার ইন্সটল করার জন্য সেখানের স্থানীয় সরকার ঝামেলা করতে পারে, অপারেটর গুলোকে পারমিশন না দিতে পারে।

যদিও এটা প্রমাণিত হয়, কিন্তু অনেকেই এটা বিশ্বাস করে ৫জি রেডিয়েশন থেকে ক্যান্সার হতে পারে। FCC এর অনুসারে তারা এখনো ৫জি সিগন্যালে ক্ষতিকর কিছু খুঁজে পায়নি, কিন্তু তারা এটাও বলেছে তাদের এখনো আরো গবেষণা করতে বাকি রয়েছে।

বর্তমানে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি ৫জি ডিভাইজ রয়েছে

দেশে ৫জি আসার পরেও সেটা মাত্র কয়েকটা শহরে বা নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় চালু করা হবে, আগেই বলেছি গ্রামীণ এলাকা গুলোতে ৫জি প্রোভাইড করা অনেক চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। যেখানে ইউএস এর মতো দেশ গুলো ৫জি প্রোভাইড করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশের কি হাল হতে পারে ভাবায় যায় না! তাই টিভিতে বড় বড় গল্প শুনিয়ে নিউজ গুলো বিশ্বাস করা থেকে বিরত থাকায় ভালো!

মনে করুণ, কোন মোবাইল অপারেটর সকল প্রয়োজনীয় আপগ্রেড করার মাধ্যমে কোনভাবে ৫জি আপনার বাসা পর্যন্ত বা শহর পর্যন্ত পৌছিয়ে দিল, কিন্তু আপনার সেটা ইউজ করার জন্য তো একটি ৫জি এনাবল্ড ডিভাইজ লাগবে তাই না? যদিও বর্তমানে আমাদের ৫জি আসবে না, কিন্তু ২০২০ এর দিকেও যদি ৫জি আসে সেক্ষেত্রে ও খুব বেশি ৫জি এনাবল্ড ডিভাইজ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবেনা। আর পাওয়া গেলেও দাম কতোটা সাধ্যের মধ্যে থাকবে সেটাও এক বিরাট প্রশ্ন!

বর্তমানে কেবল Moto Z3, Samsung Galaxy S10 5G, এবং LG V50 THINQ — এই তিনটি ডিভাইজ আমাদের জানা মতে ৫জি সাপোর্ট করে। বর্তমান ৪জি ফোনের তুলনায় আরো ১০-১৫ হাজার টাকা বেশি খরচ করতে হতে পারে, যদি ৫জি ফোন কেনার চিন্তা করেন। যদিও হয়তো ২০২০ বা ২০২১ সালের মধ্যে ২৫-৩০ হাজার টাকা রেঞ্জের মধ্যে ৫জি ফোন পাওয়ার কথা রয়েছে, কিন্তু বর্তমান মার্কেটে লাখের কাছাকাছি খরচ করতে হবে।

৫জি মানেই যে সেকেন্ডের মধ্যেই সব কিছু ডাউনলোড হয়ে যাবে, এমনটা নয় কিন্তু!

আপনার ইন্টারনেট স্পিড গিগাবিট/সেকেন্ড হয়ে যাবে, আর সেকেন্ডের মধ্যেই সব মুভি আর যেকোনো ইন্টারনেট ফাইল ডাউনলোড করে ফেলতে পারবেন — সব সময় ব্যাপারটা কিন্তু এরকম হয় না। প্রথমত, আপনি যে সার্ভার থেকে ফাইল ডাউনলোড করছেন তার ও সেই স্পিড সাপোর্ট থাকতে হবে। যদি আপনার সার্ভার কেবল 10Mbps এ লিমিটেড হয় সেক্ষেত্রে আপনার ৫জি কানেকশন যতোই 1Gbps+ হোক আপনি মাত্র 10Mbps স্পিড পর্যন্তই ডাউনলোড করতে পারবেন।

ইন্টারনেটে বেশিরভাগ সার্ভার গুলোতেই ব্যান্ডউইথ থ্রটলিং সেট করা থাকে, যাতে এক সাথে সার্ভার গুলো বেশি ইউজার সমর্থন করতে পারে। আমি খেয়াল করে দেখেছি, এমনকি নেটফ্লিক্স থেকেও মুভি ডাউনলোড করার সময় নেটফ্লিক্স ব্যান্ডউইথ থ্রটলিং সেট করে দেয়, এতে আমার ইন্টারনেট স্পিড থাকার পরেও ডাউনলোড স্পিড কমে যায়।

তাছাড়া আপনার রাউটার, ওয়াইফাই টেক, পিসির নেটওয়ার্কিং কার্ড, হার্ড ড্রাইভকে — সবাইকে গিগাবিট স্পিড সমর্থন করতে হবে, না হলে আপনি ৫জির হাই-স্পিড সম্পূর্ণভাবে ব্যাবহার করতে পারবেন না! মানে ৫জি ইউজ করার জন্য মোটামুটি হাই-এন্ড ডিভাইজ গুলো প্রয়োজনীয় হবে। আর অবশ্যই হাই-এন্ড ডিভাইজ গুলো কম দামে আসে না!


তো ৫জির মারাত্মক ফিচার গুলো দেখে এখনই এতোবেশি চোখ চমকানোর কিছু নেই, কেননা সম্পূর্ণ ৫জি পেতে আর আমাদের সেটা ইউজ করতে এখনো কয়েক বছর বাঁকি রয়েছে। ৩জি থেকে ৪জি যতো সহজেই পাওয়া গেছে, ৫জি ততো সহজে পাওয়া সম্ভব হবে না, যদি অ্যাডভান্স ৪জি কে অপারেটর’রা ৫জি বলে চালান করে তবে সেটা আলাদা ব্যাপার হতে পারে! কিন্তু ট্র্যু ৫জি এতো দ্রুত আসছে না!

/Image Credit: Shutterstock

About the author

তাহমিদ বোরহান

আমি তাহমিদ বোরহান, বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন প্রযুক্তি ব্লগার হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে বাংলায় টেক কন্টেন্ট এর বিশেষ অভাব রয়েছে, তাছাড়া উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট বেশিরভাগ মানুষের মাথার উপর দিয়েই যায়। ২০১৪ সালে প্রযুক্তি সহজ ভাষায় প্রকাশিত করার লক্ষ্য রেখেই ওয়্যারবিডি (পূর্বের নাম টেকহাবস) ব্লগের জন্ম হয়! আর এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আর্টিকেল প্রকাশিত করে বাঙ্গালীদের টেক লাইফ আরো সহজ করার ঠেকা নিয়ে রেখেছি!

সারাদিন প্রচুর পরিমাণে গান শুনি আর ইউটিউবে র‍্যান্ডম ভিডিও দেখি। ওয়ার্ডপ্রেস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভিডিও প্রোডাকশন, এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের উপরে বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। নিজের গল্প, মানুষের গল্প, আর এলোমেলো টপিক নিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে লিখি। খাওয়া আর ঘুম আমার আরেক প্যাশন!

Add comment

Categories