ক্যাসিনি-হাইগেন্সের শনি যাত্রা : এক ২০ বছরের প্রেম কাহিনী!

বৈজ্ঞানিকগন এবং বিজ্ঞান পিপাশুদের কাছে ক্যাসিনি (Cassini) ভালোবাসার এক আরেক নাম। শনিকে আমরা বর্তমানে যে নজরে দেখেছি, তা ক্যাসিনি স্পেস প্রব ছাড়া কখনোই সম্ভব হতে পারতো না। টেলিস্কোপ থেকে দেখা ফটো অনুসারে শনি এক আবছা দৃশ্য ছাড়া আর কিছুই ছিল না, কিন্তু ক্যাসিনি আমাদের যেভাবে দেখতে অভ্যস্ত করালো এতে বিজ্ঞান এই প্রবটির কাছে ঋণী!

আমি যতো গুলো স্পেস আর্টিকেল লিখেছি, এর মধ্যে শনি নিয়ে লিখতে আমার সবচাইতে ভালো লাগে। ছোট বেলায় বন্ধুদের কাছ থেকে তাদের ভূগোল বই পড়ার জন্য ধার করে নিয়ে আসতাম, ক্লাস ৯ এ আর্টস নিয়ে যারা পড়তো তাদের কাছ থেকে সাধারণ বিজ্ঞান বই নিয়ে আসতাম, সেখানে সোলার সিস্টেম নিয়ে একটি অধ্যায় ছিল, সেটা সম্পূর্ণ মুখস্ত করে ফেলেছিলাম। তখন থেকেই জানতাম শনি সকল গ্রহ থেকে আলাদা, কেননা এর বিশেষ রিং সিস্টেম রয়েছে — তারপরেও পরে যেতে হয় শনির প্রেমে।

ক্যাসিনি-হাইগেন্স মিশন থেকে যেসকল তথ্য জানতে পেরেছি, এতে ভালোবাসার মাত্রা আরো বেড়ে গেছে। যখনই নাসার ওয়েবসাইটে শনি নিয়ে কোন নতুন পোস্ট হতো, আমি হতবাক হয়ে সেগুলো উপভোগ করতাম। আজকে চিন্তা করলাম, চলুন আপনাদের সাথেও কিছু ভালো লাগা শেয়ার করা যাক। চলুন, ক্যাসিনি-হাইগেন্স (Cassini-Huygens) প্রবটি নিয়ে সম্ভাব্য সকল তথ্য গুলো জেনে নেওয়া যাক…


ক্যাসিনি-হাইগেন্স

শনিতে সর্বপ্রথম পাইওনিয়ার-১১ (Pioneer 11) নামক একটি স্পেস প্রব পাঠানো হয়, যেটা ১৯৭৯ সালের কথা — তখন প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানীগন এটা নিশ্চিত করেন যে, শনির সবচাইতে বড় চাঁদ টাইটানের ঘন বায়ুমণ্ডল রয়েছে। আর এটা সত্যিই অনেক বড় খবর, কেননা এরকম বায়ুমণ্ডল ফিচার থাকা অনেক বিরল। এই তথ্য়ের উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীদের চঞ্চলতা আরো বেড়ে যায়। তারা এতে নিশ্চিত হয়ে পড়েন, আবার অবশ্যই শনিতে গমন করতেই হবে, আর এবার পাশ কাটিয়ে উড়ে যাওয়া নয় টাইটানে ল্যান্ড করতে হবে।

কিন্তু ভয়েজার-১ এবং ভয়েজার-২ অলরেডি শনির দিকে চলছিলো, এই অবস্থায় এই প্রব দুইটিতে কিছুতেই আর ল্যান্ডার যুক্ত করানো যাবে না। আর এভাবেই ক্যাসিনি-হাইগেন্স এর জন্ম হয়। ১৯৯৭ সালের অক্টোবর মাসে প্রবটিকে স্পেস পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তবে শনিতে স্পেস প্রব পাঠানো মুখের কথা নয়, যেখানে সূর্য সবসময়ই নিজের গ্রাভিটিতে আটকে ফেলতে চায়। সূর্য বারবার চেষ্টা করে ক্যাসিনিকে কিভাবে সোলার সিস্টেমের আরো অভ্যন্তরে নিয়ে আসা যায়। এখন যদি সূর্যের গ্রাভিটির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়, অবশ্যই মারাত্মক পরিমাণে স্পীড প্রয়োজনীয় হবে।

প্রবটি নিজের স্পীড বৃদ্ধি করতে এক চালাক পন্থা অবলম্বন করে। ক্যাসিনি নিজের স্পীড বৃদ্ধি করাতে প্ল্যানেটকে ইউজ করে। কোন প্ল্যানেটের গ্রাভিটি কাজে লাগিয়ে এটি নিজের স্পীডে ধাক্কা দিয়ে নেয়। এটি প্রথমে শুক্র গ্রহে দুইবার পাক মারে তারপরে পৃথিবীর দিকে ফিরে আসে — এবার পৃথিবীর গ্রাভিটি থেকে সাহায্য নিয়ে এটি বৃহস্পতির দিকে চলে যায় আর বৃহস্পতি এক ফাইনাল ধাক্কা মেরে ক্যাসিনিকে শনিতে পাঠিয়ে দেয়।

ক্যাসিনি টাইটানকে এক্সপ্লোর করতে সাহায্য করেছে, যেখানে পৃথিবীর মতো লিকুইড সমুদ্র রয়েছে, আর যেখানে প্রান ধারণের সম্ভবনা রয়েছে অনেক গুনে বেশি। এই প্রবটির বদৌলতে শনির কমপ্লেক্স রিং সিস্টেম সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি। ক্যাসিনি থেকে পাওয়া তথ্য বিজ্ঞানীদের নতুন করে সোলার সিস্টেমের জন্ম সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য করেছে।

আরো মজার ব্যাপার উদ্ঘাটিত হবে, আপনি যদি জানেন এই প্রবটি কিভাবে নিজের পাওয়ার যোগায় সে সম্পর্কে! — এর মধ্যে রয়েছে রেডিও আইসোটোপ থার্মো ইলেকট্রিক জেনারেটর। এর পাওয়ারের প্রধান উৎস হচ্ছে ৩৩ কেজি ওজনের রেডিও অ্যাক্টিভ প্লুটোনিয়াম। বছরের পর বছর ধরে এটি পাওয়ারের জোগান দিয়ে আসছিলো এমন কি এখনো ৭০০ ওয়াটের মতো পাওয়ার উৎপন্ন করার মতো ক্ষমতা রয়েছে এর। তো বুজতেই পারছেন কতোটা শক্তিশালী জিনিষ! — তবে এর ডাউন-সাইড ও রয়েছে। যদি বিজ্ঞানীদের হিসেব কষতে কোনভাবে ভুল হয়ে যায় আর স্পেস প্রবটি পৃথিবীতে বিধ্বস্ত হয় সেক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫ হাজার মানুষ রেডিয়েশনের খপ্পরে পরে ক্যান্সারে মারা যেতে পারে। তবে এরকম সুযোগ প্রতি মিলিয়নে ১ বার, তো বিশেষ চিন্তার কোন কারণ নেই!

প্রবটি নিউক্লিয়ার শক্তি দ্বারা পরিচালিত করার কারণ হচ্ছে, ঐ সময়ে সোলার প্যানেল টেকনোলোজি ততোটা বেশি উন্নত ছিল না, আর বিশেষ করে শনি সূর্য থেকে অনেক দূরে তাই পর্যাপ্ত সোলার এনার্জি পাওয়া মুশকিল। রেডিও আইসোটোপ থার্মো ইলেকট্রিক জেনারেটরের সাথে প্রবটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত পাওয়ার পেতে পারবে, যদিও ক্যাসিনি এখন আর নেই, তবে যদি এখনো থাকতো, অবশ্যই পর্যাপ্ত পাওয়ার পেতে পারতো।

ক্যাসিনি মিশন

ক্যাসিনি মিশনের উদ্দেশ্য ছিল বহুমুখী, বিশেষ করে শনির বলয় সিস্টেম সম্পর্কে বিষদ পড়াশুনা করা এই প্রবটির প্রধান মিশনের মধ্যে একটি ছিল। তাছাড়া শনির চাঁদ গুলো এক্সপ্লোর করা, শনির ম্যাগনেটস্ফিয়ার পর্যবেক্ষণ করা, শনির বায়ুমণ্ডল সম্পর্কে পড়াশুনা করা, এবং টাইটানকে আরো মারাত্মক খুঁটিয়ে দেখবার জন্য ক্যাসিনি-হাইগেন্স কে শনি যাত্রায় পাঠানো হয়েছিলো।

হাইগেন্স…

ক্যাসিনির সাথে আসলে আরেকটি স্পেস প্রব ছিল যার নাম হাইগেন্স। এটি মূলত একটি ল্যান্ডার প্রব, যেটাকে টাইটানের পৃষ্ঠে নামিয়ে দেওয়ার জন্য ক্যাসিনির সাথে যুক্ত করা হয়েছিলো। আর একত্রে এদের নাম হচ্ছে, “ক্যাসিনি-হাইগেন্স” — বুঝলেন কাহিনী এবার?

হাইগেন্স ল্যান্ডারটি টাইটাইনে পাঠানো হয়, এবং এটিকে টাইটানের পৃষ্ঠের কি অবস্থা সেটা পর্যবেক্ষণ করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছিলো। টাইটানের বায়ুমণ্ডল এতোটায় ঘন আর ধোয়াটে যে এর পৃষ্ট স্পেস থেকে দেখা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার ছিল, তাই হাইগেন্সকে পৃষ্টে পাঠানোর পরিকল্পনা। হাইগেন্স ১.৩ মিটার প্রশস্ত এবং ৩০০ কেজি ওজন বিশিষ্ট! অরবিটার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এটি ২২ দিন স্পেসে কাটায় আর তারপরে টাইটানের বায়ুমন্ডলে ডুব মারে। এটি টাইটানের বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করার কেবল ১৫ মিনিট আগে জেগে উঠে, আর প্রবটি জেগে উঠার পরে যা দেখতে পায় সেটা বিজ্ঞানের ইতিহাসে অবিস্মরণীয়!

হাইগেন্স টাইটানের বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করার পরে বায়ুচাপ, কম্পোজিশন, বায়ুর গতি ইত্যাদির উপর রেকর্ড রাখতে আরম্ভ করে। তবে টাইটানের পৃষ্টে ল্যান্ড করার পরে খুব দ্রুতই প্রবটির ব্যাটারি লাইফ নিঃশেষ হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা মনে করেছিলেন হাইগেন্স টাইটানের কোন সমুদ্র বা লেকের উপর ল্যান্ড করবে, তাই সে অনুসারেই একে ডিজাইন করা হয়েছিলো। কিন্তু ভিডিওটি দেখলেই বুঝতে পারবেন এটি শুকিয়ে যাওয়া কোন লেকের উপর ল্যান্ড করেছিল। যাই হোক, হাইগেন্স নিয়ে অনেক আলোচনা করার ব্যাপার রয়েছে, আর সেগুলোকে এক অন্য আর্টিকেলের জন্য তুলে রাখলাম।

…আবার ক্যাসিনিতে ফিরে আসা যাক

যদি ক্যাসিনি মিশনের কথা আলচনা করা হয়, অবশ্যই এটি মারাত্মক পরিমাণে সফল একটি মিশন।

এটি বিগত ১৩ বছর ধরে নানান টাইপের বৈজ্ঞানিক ডাটা পৃথিবীতে সেন্ড করেছে। তাছাড়া স্পেস থেকে কিছু শ্বাসরোধ করা ফটো সেন্ড করেছে যা ক্যাসিনি ছাড়া আগে কখনোই আমাদের চোখ বুলানোর ভাগ্য ছিল না। নাসার বদৌলতে তাদের ওয়েবসাইট থেকে আপনি ক্যাসিনি মিশনের বহু ফটো পেয়ে যাবেন। আপনি চাইলে এই লিংক থেকে এগুলো এক্সপ্লোর করতে পারেন। আর ফটো গুলো এক্সপ্লোর করার সময় নিজের ভাষা হারিয়ে ফেললে আমি দায়ী থাকবো না মোটেও!

এই গ্যালারীর ইমেজ গুলো কিন্তু একেবারেই রিয়াল জাস্ট ট্রু কালারে কারেক্ট করা হয়েছে, তাই এগুলোকে সিজিয়াই মনে করবেন না যেন! হ্যাঁ, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে বলুন।

ক্যাসিনি বর্তমানে কি করছে?

বর্তমানে ক্যাসিনির কোন অস্তিত্ব নেই, এটি এখন শনিরই একটি অংশে পরিণত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যাসিনি শনির বায়ুমন্ডলে বাষ্পে পরিণত হয়ে গেছে। কিন্তু এটি পুড়ে হাওয়া হয়ে যাওয়ার পূর্বে অনেক কিছু প্রদান করে গেছে। ইতিহাসের সবচাইতে কাছ থেকে এটি শনি, শনির রিং সিস্টেম, এবং এর চাঁদ গুলোর পাশ কাটিয়ে উড়ে গেছে। প্রবটি শনির বায়ুমণ্ডলে মিশিয়ে যাওয়ার পূর্বে গ্রহটির এবং রিং সিস্টেমের অনেক কাছ ঘেঁষে উড়ে যায় সাথে অত্যন্ত রিচ এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কালেক্ট করে যেগুলো কখনো কল্পনাও করা সম্ভব ছিল না।

ক্যাসিনি শনির গ্রাভিটি এবং ম্যাগনেটিক ফিল্ড এর অত্যন্ত খুঁটিনাটিভাবে ম্যাপ তৈরি করে, এমনকি শনি গ্রহটির কোর কিভাবে গঠিত হতে পারে এই সম্পর্কেও বিস্তারিত ডাটা জানতে পারে বিজ্ঞানীগন। তাছাড়া এর রিং সিস্টেমে কতো গুলো ম্যাটেরিয়াল রয়েছে তারও বর্ণনা দিয়ে যায় স্পেস প্রবটি। এই ডাটা গুলো থেকে আমাদের জ্ঞানকে আরো উন্নত করা সম্ভব হয়েছে যে কিভাবে আমাদের সোলার সিস্টেমে গ্যাস জায়েন্ট গুলোর জন্ম হয়েছিলো।

প্রবটি পাঠানো থেকে শুরু করে শনির বায়ুমন্ডলে বাষ্পে পরিণত হওয়া পর্যন্ত এটি ২০ বছরের মিশন সম্পূর্ণ করে। আর এটি আমাদের বারবার ভাবাতে সাহায্য করেছে যে হয়তো বা টাইটান বা এনসেলাডাস এ ক্ষুদ্র প্রানের সম্ভবনা থাকতে পারে। এ এক রোমাঞ্চকর প্রেম কাহিনী, যেখানে জ্ঞানের অফুরন্ত ভালো লাগার ব্যাপার লিপ্ত হয়ে রয়েছে। আমি জানি, আপনিও একজন স্পেস প্রেমি আর আমাদের অনুভূতি প্রায়ই সমান।

/Image Credit: Shutterstock

About the author

তাহমিদ বোরহান

আমি তাহমিদ বোরহান, বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন প্রযুক্তি ব্লগার হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে বাংলায় টেক কন্টেন্ট এর বিশেষ অভাব রয়েছে, তাছাড়া উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট বেশিরভাগ মানুষের মাথার উপর দিয়েই যায়। ২০১৪ সালে প্রযুক্তি সহজ ভাষায় প্রকাশিত করার লক্ষ্য রেখেই ওয়্যারবিডি (পূর্বের নাম টেকহাবস) ব্লগের জন্ম হয়! আর এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আর্টিকেল প্রকাশিত করে বাঙ্গালীদের টেক লাইফ আরো সহজ করার ঠেকা নিয়ে রেখেছি!

সারাদিন প্রচুর পরিমাণে গান শুনি আর ইউটিউবে র‍্যান্ডম ভিডিও দেখি। ওয়ার্ডপ্রেস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভিডিও প্রোডাকশন, এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের উপরে বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। নিজের গল্প, মানুষের গল্প, আর এলোমেলো টপিক নিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে লিখি। খাওয়া আর ঘুম আমার আরেক প্যাশন!

Add comment

Categories