আলোক বর্ষ : কিভাবে জ্যোতির্বিজ্ঞানীগন কোন তারার দূরত্ব নির্ণয় করেন?

আলো নিঃসন্দেহে অনেক দ্রুতগতির — আমাদের জানা মতে এই ইউনিভার্সের সবচাইতে ফাস্ট জিনিষই হচ্ছে এই আলো! যেহেতু আলো অনেক ফাস্ট, তাই চরম দূরত্বে থাকা অবজেক্ট গুলোর দূরত্ব নির্ণয় করতে আলোর গতির সাথে তুলনা হয়। আলো প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩০০,০০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে যেটা ১ ঘণ্টায় দাড়ায় প্রায় ১,০৭৯,০০০,০০০ কিলোমিটার এবং ১ বছরে আলো প্রায় ৬ ট্রিলিয়ন মাইল দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে, আর এই ১ বছরের আলোর ভ্রমনের দূরত্বকে ১ আলোক বর্ষ বলা হয়ে থাকে।

আলোর গতিবেগ সম্পর্কে আরেকটু পরিস্কার হওয়ার জন্য কিছু উদাহরণ নেওয়া যাক। পৃথিবী থেকে চাঁদে পৌছাতে অ্যাপোলো জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সময় লেগেছিল ৪ দিন, যদি তারা আলোর বেগে পৌঁছাত, সময় লাগতো ১ আলোক সেকেন্ড। অপরদিকে আমাদের সূর্যের সবচাইতে কাছের নক্ষত্রটির নাম প্রক্সিমা সেন্টরাই — যেখানে পৌছাতে ৪.২৪ আলোক বর্ষ অতিক্রম করতে হবে। আমাদের নিজস্ব গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌছাতে সময় লাগবে প্রায় ১০০,০০০ আলোক বর্ষ। পৃথিবী থেকে সবচাইতে কাছের গ্যালাক্সি অ্যান্ড্রমেডাতে পৌছাতে সময় লাগবে প্রায় ২,৫০০,০০০ আলোক বর্ষ।

তো এখন নিজেই বোঝার চেষ্টা করুণ, মহাকাশ কতোটা বিশালভাবে বড়, এর আঁকার আমাদের দুর্বল বাঁদরের মস্তিষ্কে কল্পনা করাও মুশকিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে স্পেসে চরম দূরত্বে থাকা অবজেক্ট গুলোর দূরত্ব পরিমাপ করা হয়? কিভাবে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা জানেন, কোন নক্ষত্রের দূরত্ব কতোটুকু? — যদি একবারের জন্যও এই প্রশ্ন আপনাকে বিচলিত করে থাকে, এই আর্টিকেলেই এর পরিস্কার উত্তর রয়েছে।


নক্ষত্রের দূরত্ব নির্ণয়

জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে পৃথিবী থেকে কোন নক্ষত্রের দূরত্ব নির্ণয় করা বা দূরে থাকা যেকোনো স্পেস অবজেক্টের দূরত্ব নির্ণয় করা একটি মজাদার সমস্যা! তবে কোন স্টার ঠিক কতো দূরে অবস্থিত সেটা পরিমাপ করার জন্য দুইটি প্রধান পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। প্রথম পদ্ধতিটির নাম হচ্ছে- ট্রায়াঙ্গুলেশন (Triangulation) বা প্যারালাক্স (Parallax) এবং দ্বিতীয়ত ব্রাইটনেস মেজারমেন্টস (Brightness Measurements)।

নিচের প্যারাগ্রাফ গুলোতে এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো!

ত্রিকোণমিতি প্যারালাক্স বা ট্রায়াঙ্গুলেশন

বাসে বা ট্রেনে করে অবশ্যই ভ্রমন করেছেন রাইট? তাহলে অবশ্যই এটা খেয়াল করে দেখে থাকবেন যে, বাসের জানালা দিয়ে দেখতে পাওয়া রাস্তার দুই পাশের গাছ গুলো অনেক দ্রুত ক্রস করে, কিন্তু দূরে অবস্থিত কোন গাছ বা বাড়িঘর মোটেও দ্রুত ক্রস করে না। দূরের কোন অবজেক্ট ধীরেধীরে সরে যায়, তবে সেটা যতোদূরে অবস্থিত হয় ততোই দেরিতে সেই অবজেক্ট জানালা থেকে সরে যেতে দেখা যায়।

আরেকটি রিয়াল লাইফ এক্সাম্পল হচ্ছে, আপনার বৃদ্ধাঙ্গুলিকে চোখের সামনে ধরুন, (যেমনটা ফেসবুক লাইক বাটন হয়, ঠিক ঐ রকম করে) তারপরে বাম চোখ বন্ধ করে জাস্ট ডান চোখ দিয়ে আঙ্গুলটির দিকে তাকান, এরপরে এবার হাত না নরিয়ে ডান চোখটি বন্ধ করে বাম চোখ দিয়ে আঙ্গুলটির দিকে তাকান। এবার দেখে মনে হবে হাতটি যেন একটু সরে গেলো। আমরা যখন দুই চোখ দিয়ে কোন অবজেক্ট দেখি, আমাদের দুই চোখ এবং অবজেক্টটির মধ্যে একটি ত্রিকোণের সৃষ্টি হয়, আর এই ত্রিকোণ থেকে আমাদের ব্রেইন একটি সঠিক দূরত্ব পরিমাপ করে।

এই ইফেক্টকেই মূলত ট্রায়াঙ্গুলেশন বলা হয়। যখন কোন দূরে থাকা মহাকাশ অবজেক্টের দিকে তাকানো হয়, এই সেম ইফেক্টই কাজ করে। বাট মহাকাশের নক্ষত্র গুলো এতোদূরে থাকে যে, আমরা যদি পৃথিবীর দুই প্রান্তে দুইটি টেলিস্কোপ বসায়, তারপরেও ট্রায়াঙ্গুলেশনের জন্য যথেষ্ট লাইন ক্রিয়েট করতে পারবো না, কেননা আমাদের পৃথিবীর সাইজ খুব বেশি বড় নয়।

কিন্তু আমরা সবাই জানি, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে, এরমানে এখন যদি এক অবস্থানে থাকে, ৬ মাস পরে পৃথিবী ঠিক সূর্যের অপরদিকে থাকবে, আর এই লাইন কিন্তু অনেক বিশাল, মোটামুটি ৩০০ মিলিয়ন কিলোমিটার! এখন এক সময়ে কোন নক্ষত্রের দিকে দেখে যদি আবার ৬ মাস পরে সেই নক্ষত্রের দিকে দেখা হয়, সেক্ষেত্রে বিশাল একটি ত্রিকোণ তৈরি করা যাবে, ফলে জ্যোতির্বিদগন ঐ স্টারের অবস্থানের পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারবে। এরপরে হাইস্কুল লেভেলের জ্যামিতি খাটিয়ে নিমিয়েই দূরের তারাটির সঠিক দূরত্ব বের করা সম্ভব হবে।

আপনার এক্সট্রা জ্ঞানের জন্য জানিয়ে রাখি, এই ট্রায়াঙ্গুলেশন পদ্ধতি কাজে লাগিয়েই কিন্তু জিপিএস স্যাটেলাইট লোকেশন নির্ণয় করে বা সেলফোন ট্র্যাক করে লোকেশন খুঁজে বের করা হয়।

তবে এই সিস্টেমের একটি লিমিটেশন রয়েছে। প্যারালাক্স ম্যাথড ইউজ করে কেবল ৪০০ আলোক বর্ষ দূর পর্যন্ত স্টারের দূরত্ব পরিমাপ করা সম্ভব। এরপরের দূরত্বের স্টার গুলো পরিমাপ করার ক্ষেত্রে প্যারালাক্স ম্যাথড আর কাজ করবে না। কিন্তু এরকম হলে তো চলবে না, আমাদের নিজস্ব গ্যালাক্সিই ১০০,০০০ আলোক বর্ষ, সে অনুসারে ৪০০ আলোক বর্ষ অনেক ছোট দূরত্ব। আলাদা গ্যালাক্সির স্টার গুলোর কথা তো বাদই দিলাম।

ব্রাইটনেস মেজারমেন্টস

পৃথিবী থেকে ৪০০ আলোক বর্ষ দূরের স্টারের দূরত্ব পরিমাপ করার জন্য এখনো কোন ডাইরেক্ট ম্যাথড নেই জ্যোতির্বিদগনের কাছে, সুতরাং জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ব্রাইটনেস মেজারমেন্টস পদ্ধতি ব্যবহার করেন। প্রত্যেকটি নক্ষত্র থেকে আসা আলোর কালার স্পেকট্রাম থেকে স্টারটির আসল ব্রাইটনেস লেভেল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। পৃথিবীর কাছে যে স্টার গুলো রয়েছে সেগুলোর কালার স্পেকট্রাম থেকে ব্রাইটনেস নির্ণয় করে এই ব্যাপারটি প্রমাণিত করা হয়েছে।

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই একই সূত্র ব্যবহার করে আরো দূরের নক্ষত্র গুলোর স্পেকট্রাম এক্সপ্লোর করতে পারেন। কালার স্পেকট্রাম থেকে আসল ব্রাইটনেস পাওয়া যায় এবং যখন আসল ব্রাইটনেস ডাটা কাছে থাকে আর পৃথিবী থেকে দেখতে এর ব্রাইটনেস কতোটা দেখতে পাওয়া যায় — এই দুই ব্রাইটনেসের মধ্যে হিসেব করলে সহজেই স্টারটির আসল দূরত্ব পাওয়া যেতে পারে। তাছাড়া কালার স্পেকট্রাম থেকে নক্ষত্রটি কতোটা গরম বা ঠাণ্ডা, এতে কোন কোন গ্যাস মজুদ রয়েছে, ইত্যাদি আরো অনেক তথ্য পাওয়া যেতে পারে।

এই ম্যাথডেরও একটি লিমিটেশন রয়েছে। মিলিয়ন আলোক বর্ষ দূরের গ্যালাক্সি গুলো দেখতে অত্যন্ত ঘোলা তাই এই পদ্ধতি অ্যাপ্লাই করা অনেক ট্রিকি হয়ে দাড়ায়। এক্ষেত্রে বিস্ফোরিত নক্ষত্র গুলো যার নাম সুপারনোভা, এরা অত্যন্ত উজ্জ্বল হয়ে থাকে, এদের কালার স্পেকট্রাম থেকে দূর গ্যালাক্সির দূরত্ব নির্ণয় করা হয়ে থাকে।


কিন্তু কেন এই দূরত্ব পরিমাপ? ওয়েল, এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে যেগুলো সিরিজ আর্টিকেল আকারে প্রকাশ না করলে মাথা মুন্ডু বোঝা দ্বায়। সূর্য থেকে আলো পৃথিবীতে পৌছাতে ৮ মিনিটের মতো সময় লাগে। এর মানে আপনি বর্তমানে যে সূর্যের ছবিটি আকাশে দেখতে পাচ্ছেন সেটা ৮ মিনিটের পুরাতন ভার্সন।

মহাকাশের নানান গ্যালাক্সি আর স্টার গুলো মিলিয়ন আলোক বর্ষ দূরে রয়েছে, তাদের আলো পৃথিবীতে পৌছাতেও মিলিয়ন বছর সময় লেগেছে, এর মানে কোন মিলিয়ন আলোক বর্ষ দূরে থাকা স্টারকে আজ পৃথিবী থেকে দেখতে পাচ্ছেন কিন্তু সেটা মিলিয়ন বছর আগের ছবি।

তো কি বুঝলেন? এই ইউনিভার্স নিজে থেকেই এক বিশাল টাইম মেশিন। কোন অবজেক্টকে যতো দূর থেকে দেখবেন, ততোই তার তরুণ ভার্সন দেখা যাবে। আমাদের পৃথিবীকে যদি কেউ ১ মিলিয়ন আলোক বর্ষ থেকে আজ দেখতে পায়, এর মানে সে ১ মিলিয়ন বছর পেছনের পৃথিবীকে দেখতে পাবে, কেননা আলো তার পর্যন্ত পৌছাতে ১ মিলিয়ন বছর সময় নিয়েছে। এই ইউনিভার্স লাগাতার আলোর রুপে আমাদের নানান ইনফরমেশন সেন্ড করেই চলেছে, আমাদের শুধু সেগুলোকে ক্র্যাক করতে হবে!

Image Credit: Shutterstock

About the author

তাহমিদ বোরহান

আমি তাহমিদ বোরহান, বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন প্রযুক্তি ব্লগার হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে বাংলায় টেক কন্টেন্ট এর বিশেষ অভাব রয়েছে, তাছাড়া উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট বেশিরভাগ মানুষের মাথার উপর দিয়েই যায়। ২০১৪ সালে প্রযুক্তি সহজ ভাষায় প্রকাশিত করার লক্ষ্য রেখেই ওয়্যারবিডি (পূর্বের নাম টেকহাবস) ব্লগের জন্ম হয়! আর এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আর্টিকেল প্রকাশিত করে বাঙ্গালীদের টেক লাইফ আরো সহজ করার ঠেকা নিয়ে রেখেছি!

সারাদিন প্রচুর পরিমাণে গান শুনি আর ইউটিউবে র‍্যান্ডম ভিডিও দেখি। ওয়ার্ডপ্রেস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভিডিও প্রোডাকশন, এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের উপরে বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। নিজের গল্প, মানুষের গল্প, আর এলোমেলো টপিক নিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে লিখি। খাওয়া আর ঘুম আমার আরেক প্যাশন!

Add comment

Categories