আলট্রা সাউন্ড | শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে কীভাবে ঘন বস্তুর ভেতরে দেখা সম্ভব?

আপনি মানুষকে প্রায়ই একটি বুলি ব্যবহার করতে শুনে থাকবেন হয়তো, “বাদুড়ের মতো অন্ধ”—যদি বাদুড় কথা বলতে পারতো তবে এরাও মানুষকে “মানুষের মতো ঠসা” বলে বদলা নিত। আপনি হয়তো ভাবেন, যে আমরা মানুষেরা কানে অনেক ভালো শুনি—কিন্তু আমাদের কান শব্দ তরঙ্গের অনেক সংকীর্ণ ব্যান্ডই মাত্র সনাক্ত করতে পারে। আমাদের শ্রাব্যতার পাল্লা থেকে অনেক বেশি বাদুড়, ডলফিন, কাপড়-কাটা পোকা, এবং অন্যান্য প্রাণীরা শুনতে পায়, আর এই শব্দকেই আলট্রা সাউন্ড (Ultrasound) বলা হয়, যা আমরা শুনতে পাইনা। বিজ্ঞানীগন আলট্রা সাউন্ড আবিস্কারের পরপরি এর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারও আবিষ্কার করেছেন। আজকের প্রশ্ন হলো, এই আলট্রা সাউন্ড কীভাবে কাজ করে, চলুন বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।

আলট্রা সাউন্ড কি?

মানুষের কান শুধু সেই শব্দকেই শুনতে পারে যার প্রতি সেকেন্ডে ২০ বার থেকে ২০,০০০ বার কম্পাঙ্ক রয়েছে। (এখানে ছোট্ট একটি তথ্য শেয়ার করতে চাই, তা হলো, ছোট বাচ্চারা তাদের পিতামাতার চাইতে বেশি কম্পাঙ্কের শব্দ শুনতে পারে—কারন আমাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের বেশি কম্পাঙ্কের শব্দ শোনার ক্ষমতা লোপ পায়)। আরো বৈজ্ঞানিকভাবে বলতে, আমরা শুধু সেই শব্দ তরঙ্গকেই শুনতে পাই, যা ২০-২০,০০০ হার্জের মধ্যে হয়ে থাকে। হার্জ হলো শব্দের কম্পাঙ্ক পরিমাপ করার একটি নির্ধারক, ১ হার্জ মানে হলো কোন শব্দের কম্পাঙ্ক প্রতি সেকেন্ডে ১ বার। আমাদের কণ্ঠস্বর হতে উৎপাদিত শব্দ মাত্র কয়েকশত হার্জ থেকে কয়েক হাজার হার্জ পর্যন্ত হতে পারে।

মনেকরুন, আপনি কোন ড্রাম বাদকের কাছে বসে আছেন, সে ড্রাম বাজাচ্ছে এবং ড্রামের ত্বক থেকে যে শব্দ উৎপাদিত হচ্ছে তা ২০,০০০ হার্জ এর উপরে। তাহলে আপনি শুধু ড্রামের ত্বক কাঁপতেই দেখতে পাবেন, কিন্তু এথেকে কোন শব্দ উৎপন্ন হতে শোনা যাবেনা। ড্রামটি কিন্তু শব্দ তরঙ্গ উৎপন্ন করেই চলেছে, কিন্তু আপনার কান তা শুনতে পাবে না। যদিও বাদুড়, ডলফিন, বা কাপড়-কাটা পোকা সেই শব্দকে আরামে শুনতে পাবে। যাই হোক, এক কথায়—এমন কোন শব্দ তরঙ্গ যা মানুষের কানে শোনা যাবেনা সেটাই হলো আলট্রা সাউন্ড

এখানে আরেকটি মজার তথ্য শেয়ার করতে চাই, তা হলো, আমরা যেমন বেশি কম্পাঙ্কের শব্দ শুনতে পাইনা, ঠিক তেমনি একদম কম কম্পাঙ্কের শব্দও আমরা শুনতে পাইনা। আর এই শব্দকে ইনফ্রা সাউন্ড (Infrasound) বলা হয়। ভূকম্পীয় তরঙ্গকে আমরা ভূমিকম্পের উদাহরণ হিসেবে ধরি। ভূমিকম্প ডিটেক্ট করার জন্য একটি বিশেষ ধরনের ডিটেক্টর ব্যবহার করা হয়—কেনোনা এই তরঙ্গ আমরা সর্বদা শুনতে সক্ষম হইনা।

সাধারন শব্দ তরঙ্গ হতে আলট্রা সাউন্ড তরঙ্গে উচ্চ মাত্রার কম্পাঙ্ক থাকে, কিন্তু আবার এদের খাটো তরঙ্গদৈর্ঘ্যেও রয়েছে। একটি তরঙ্গ বাতাসের মধ্য দিয়ে দূরত্ব অতিক্রম করে এবং আরেকটি তরঙ্গ ঠিক এর পেছন পেছন চলে। আর এই দ্বিতীয় তরঙ্গটি সাধারন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে থেকে ছোট হয়। আর এর ব্যস্তব গুরুত্বও রয়েছে—আলট্রা সাউন্ড তরঙ্গ কোন বস্তুর থেকে বেশি ভালো প্রতিফলিত হতে পারে (সাধারন শব্দের তুলনায়)।

কীভাবে আলট্রাসাউন্ড তৈরি করা হয়?

আমরা কোন জিনিসকে আঘাত করে বা প্রবাহিত করে যেভাবে সাধারন শব্দ সৃষ্টি করি, সেই একই পদ্ধতিতে আলট্রাসাউন্ড উৎপন্ন করা অসম্ভব। কেনোনা আমরা এতো দ্রুত কোন জিনিসকে আঘাত করতে পারিনা। তাই আলট্রাসাউন্ড উৎপন্ন করার জন্য আমাদের প্রয়োজন পড়ে এক ধরনের ইলেকট্রিকাল উপকরন, যা অত্যন্ত হাই ফ্রিকোয়েন্সিতে ভাইব্রেট করতে পারে। কিছু ক্রিস্টালে যেমন কোয়ার্টজে ইলেক্ট্রিসিটি প্রবাহ করালে এটি অত্যন্ত দ্রুত কাঁপতে পারে—আর এই ইফেক্টকে পাইজো ইলেক্ট্রিসিটি (piezoelectricity) বলা হয়।

ইলেক্ট্রিসিটি বাদেও ম্যাগনেটিজম থেকেও আলট্রা সাউন্ড উৎপন্ন করা যায়। যেভাবে কিছু ক্রিস্টাল ইলেক্ট্রিসিটি থেকে আলট্রাসাউন্ড উৎপন্ন করে, তেমনি অন্যকিছু ক্রিস্টাল রয়েছে যারা ম্যাগনেটিজম থেকে আলট্রাসাউন্ড তৈরি করে। আর এই ইফেক্টকে ম্যাগনেটসট্রিক্সন (magnetostriction) বলা হয়।

আলট্রা সাউন্ডের ব্যবহার

আলট্রা সাউন্ডকে হাঁসপাতালে ব্যবহার হওয়ার জন্য সর্বাধিক জানা যায়। আলট্রা সনিক ব্যবহার করে ডাক্তার অসুস্থ শরীরের ভেতরে দেখতে সক্ষম হন, কোন প্রকার না কেটে। তাছাড়া এয়ারপ্লেন বা জেট ইঞ্জিনের ত্রুটি খোঁজার জন্যও আলট্রা সাউন্ড ব্যবহার করা হয়। যদি ধাতুর গভীরে কোন ফাটল থাকে তবে তা এই সাউন্ড ব্যবহার করে পরিদর্শন করা করা সম্ভব। কেনোনা ফাটল থাকা ধাতু থেকে আরেক প্রকারের আলট্রাসাউন্ড প্রতিফলিত হয়।

শেষ কথা

আজকের পোস্টটি অনেক ছোট ছিল, কিন্তু তারপরেও কিছু মজার এবং অজানা তথ্য সম্পর্কে অবগত হয়েছেন নিশ্চয়। আলট্রা সাউন্ডের আরো কোন ব্যবহার জানা থাকলে আমাদের নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। সাথে পোস্টটি শেয়ার করতে একদমই ভুলবেন না।

Image Credit: Shutterstock

About the author

তাহমিদ বোরহান

আমি তাহমিদ বোরহান, বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন প্রযুক্তি ব্লগার হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে বাংলায় টেক কন্টেন্ট এর বিশেষ অভাব রয়েছে, তাছাড়া উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট বেশিরভাগ মানুষের মাথার উপর দিয়েই যায়। ২০১৪ সালে প্রযুক্তি সহজ ভাষায় প্রকাশিত করার লক্ষ্য রেখেই ওয়্যারবিডি (পূর্বের নাম টেকহাবস) ব্লগের জন্ম হয়! আর এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আর্টিকেল প্রকাশিত করে বাঙ্গালীদের টেক লাইফ আরো সহজ করার ঠেকা নিয়ে রেখেছি!

সারাদিন প্রচুর পরিমাণে গান শুনি আর ইউটিউবে র‍্যান্ডম ভিডিও দেখি। ওয়ার্ডপ্রেস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভিডিও প্রোডাকশন, এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের উপরে বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। নিজের গল্প, মানুষের গল্প, আর এলোমেলো টপিক নিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে লিখি। খাওয়া আর ঘুম আমার আরেক প্যাশন!

Add comment

Categories