ভয়েজার ১ : ঠিক কতোদূর পৌছিয়ে আমাদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবে?

আমাদের সৌরজগতের উপর এবং বাইরে আরো বেটার পড়াশুনার করার জন্য ১৯৭৭ সালে ভয়েজার ১ স্পেস প্রোব মহাকাশে পাঠানো হয়। মানুষের তৈরি অনেক স্পেস ক্র্যাফট মহাকাশে পাঠানো হয়েছে, এদের ভয়েজার (Voyager) সবচাইতে অন্যতম। ভয়েজার ১ আমাদের এমন কিছু দেখিয়েছে, বুঝিয়েছে যেগুলোর কল্পনাও ছিল না আমাদের। পৃথিবী থেকে সৌরজগতের প্রত্যেকটি গ্রহের হাই রেজুলেশন ফটো কেবল ভয়েজারের বদৌলতেই সম্ভব হয়েছিল।

আজ ৪১ বছরেরও বেশি সময় ধরে যাত্রা অতিক্রম করে প্রোবটি পৃথিবী থেকে প্রায় ২১ বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আর যানটি ১৭ কিলোমিটার/সেকেন্ড স্পীডে ছুটে চলে আজ পৃথিবী থেকে প্রায় ১৪১ অ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল ইউনিট (Astronomical Unit) দূরে রয়েছে। সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব অনুসারে অ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল ইউনিট মাপা হয়, এখানে একবার সূর্য থেকে পৃথিবীর সমান দূরত্ব (১৫০ মিলিয়ন কিলোমিটার) অতিক্রম করলে ১ অ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল ইউনিট ধরা হয়।

ভয়েজার ১ বর্তমানে মানুষের তৈরি সবচাইতে দূরত্বে অবস্থান করা অবজেক্ট। আর সবচাইতে বড় কথা হচ্ছে আমরা এখনো ভয়েজার ১ এর সাথে যোগাযোগ রাখতে সক্ষম হয়ে চলেছি। কিন্তু ঠিক কতোদূরে এই স্পেস প্রোবটি চলে যাওয়ার পরে পৃথিবী থেকে কোন যোগাযোগ সম্ভব হবে না? এই আর্টিকেলে এই বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে।


ভয়েজার কমুনিকেশন সিস্টেম

আজকের আর্টিকেলের প্রধান হাই লাইটেড প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে পেতে অবশ্যই প্রথমে আমাদের জানতে হবে ভয়েজার ১ কিভাবে ২১ বিলিয়ন কিলোমিটার দূর থেকে এখনো আমাদের সাথে ডাটা ট্রান্সমিট করেই চলেছে?

বেতার তরঙ্গর মাধ্যমে ২০ কিলোওয়াট পাওয়ারের সিগন্যাল পৃথিবী থেকে ভয়েজার ১ এর উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়ে থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই সিগন্যাল ভয়েজার ১ এর কাছে পৌছাতে প্রায় ২০ ঘণ্টা বা আরো বেশি সময় লেগে যায়, তারপরে প্রোবটি হাইলি সেন্সিটিভ এন্টেনা সেই সিগন্যাল ক্যাচ করে। যদি মঙ্গল গ্রহে পাঠানো সিগন্যালের সাথে তুলনা করতে চান, তাহলে পৃথিবী থেকে মঙ্গলে সিগন্যাল পাঠাতে প্রায় ১৫ মিনিট সময় (মঙ্গল ও পৃথিবীর বর্তমান দূরত্বের উপর নির্ভর করে) লাগে এবং ফিরে আসতেও একই সময় লাগে।

ভয়েজার-১ আবার পৃথিবীর উদ্দেশ্যে ২০ কিলোওয়াট পাওয়ারের রেডিও সিগন্যাল সেন্ড করে দেয়। তবে স্পেসে ভ্রমন করতে করতে সিগন্যাল কোয়ালিটি অনেক দুর্বল হয়ে যায় আর পৃথিবীতে সিগন্যালটি পৌছাতে পৌছাতে এতো দুর্বল হয়ে পরে যেটা অনেক কষ্টে ডিটেক্ট করতে হয়। তবে ভালো ব্যাপার হচ্ছে এতো দূরের অবজেক্টের সাথে যোগাযোগ করতে আমাদের হাই কোয়ালিটি সিগন্যালের প্রয়োজনই নেই, জাস্ট কোনমতে সিগন্যাল আমাদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছালেই কাজ হয়ে যাবে।

নাসা এরকম দুর্বল স্পেস সিগন্যাল গুলো রিসিভ করার জন্য ডীপ স্পেস নেটওয়ার্ক সিস্টেম ব্যবহার করে। যেখানে পৃথিবীর ৩ প্রান্তে তিনটি এন্টেনা কমপ্লেক্স ভাবে কাজ করে। একটি এন্টেনা অ্যামেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াতে, দ্বিতীয়টি স্পেনের মাদ্রিদে, তৃতীয়টি অস্ট্রেলিয়াতে অবস্থিত। প্রত্যেকটি লোকেশনে ৭০ মিটারের হিউজ সাইজের এন্টেনা রয়েছে। সাথে আরো অনেক ৩৪ মিটারের এন্টেনা রয়েছে যেগুলো একত্রে সাধারণ এফএম রেডিও সিগন্যালের তুলনায় ১০০০ গুন দুর্বল সিগন্যালকেও ডিটেক্ট করার ক্ষমতা রাখে।

এই তিন লোকেশনের ডীপ স্পেস নেটওয়ার্ক কয়েক ঘণ্টা সময় ব্যয় করে সিগন্যাল গুলো শুনতে থাকে যাতে ভয়েজার ১ আমাদের সাথে কথা বলতে পারে। আর এভাবেই এই প্রোবটি আমাদের সাথে লাগাতার কথা বলতেই থাকে। কিন্তু এই স্পেস প্রোবটি দিনের পর দিন আরো অনেক গভীর স্পেসের দিকে চলে যাচ্ছে মানে অনেক বেশি দূরত্বে সরে যাচ্ছে, তাহলে কিভাবে কমুনিকেশন জারি রাখা সম্ভব হবে?

কাহিনী হচ্ছে পেছনের ৫০ বছরে আমরা রেডিও সিগন্যাল সেন্ড এবং রিসিভের উপরে যেরকম নাটকীয় উন্নতি সাধিত করেছি তাতে আমাদের কাছে কোন লিমিটই নেই আমরা স্পেসে ঠিক কতোদূর পর্যন্ত সিগন্যাল পাঠাতে বা শুনতে পারবো। আমরা বর্তমানে অনায়াসে আমাদের থেকে বহু আলোকবর্ষ (৩ লাখ কিলোমিটার/সেকেন্ড স্পীড এ ১ বছর চললে ১ আলোকবর্ষ ধরা হয়) দূরে সিগন্যাল সেন্ড/রিসিভ করতে পারি।

ভয়েজারের শেষ সিগন্যাল

ভয়েজার যতোই পৃথিবী থেকে আরো এবং আরো দূরত্বে গমন করছে, ভয়েজারের সাথে সিগন্যাল রিসিভ এবং সেন্ড আরো সময় সাপেক্ষ হয়ে পড়ছে। সিগন্যাল পাওয়ার অনেক দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং ডাটা রেট আরো স্লো হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। দিন দিন এই প্রোবের সাথে যোগাযোগ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ছে।

আগেই বলেছি, আমাদের কাছে দূরত্ব তেমন কোন ফ্যাক্টর নয়। যতদূর থেকেই সিগন্যাল আসুক আমরা ঠিকই শুনতে পাবো, যতক্ষণ আমাদের এন্টেনা সেটা রিসিভ করার ক্ষমতা রাখে ততোক্ষণ যোগাযোগ এ সমস্যা হবে না। কিন্তু ভয়েজারের সাথে আমাদের যোগাযোগ কেবল মাত্র কয়েক বছরই আর সম্ভব হবে।

যেহেতু ভয়েজার ১ নিউক্লিয়ার পাওয়ার দ্বারা পরিচালিত, তাই এর ইলেকট্রিক্যাল পাওয়ার দিনের পর দিন হ্রাস পাচ্ছে। ১৯৯০ সালে, পাওয়ার সেভিং করতে ভয়েজার ১ এর ক্যামেরা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। “পেল ব্লু ডট” ইমেজ ক্যাপচার করার পড়েই ভয়েজার ইঞ্জিনিয়ার এর ক্যামেরা অফ করে দেয়। এটাই প্রোবটির ক্যামেরার শেষ ক্যাপচার করা ইমেজ, যেখানে পৃথিবী একটি সিঙ্গেল পিক্সেলে দেখা যাচ্ছিলো।

আজকে ভয়েজারে মোট ১১টির মধ্যে কেবল ৪টি বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি অ্যাক্টিভ রয়েছে। এই যন্ত্র গুলো আমাদের সোলার সিস্টেমের বাইরের ম্যাগনেটিক ফিল্ড, সোলার উইন্ড, এবং কজমিক রে থেকে ডাটা কালেক্ট করার কাজ করছে।

সর্বশেষ উত্তর

মোটামুটি ৮ বছরের মধ্যে ভয়েজার ১ এর সাথে আমাদের আর কোন যোগাযোগ রাখা সম্ভব হবে না। কেননা ভয়েজার ১ সম্পূর্ণরুপে আউট অফ পাওয়ার হয়ে পরবে এবং কোন যন্ত্রাংশই চালু করে রাখা সম্ভব হবে না। বিজ্ঞানীরা এর সেন্ড করা লাস্ট বিট অফ ডাটা পর্যন্ত তথ্য রিসিভ করবে এবং সংরক্ষন করবে। তারপরে স্পেস প্রোবটি নিরবে মহাকাশের গহ্বরে বিলীন হয়ে পরবে। আর কোন দিনই একে খুঁজে পাওয়া বা এর থেকে কিছু শোনা সম্ভব হবে না।


তো এতক্ষণে আশা করছি আপনি মোটামুটি পরিস্কার যে কিভাবে এবং কখন থেকে ভয়েজার স্পেস প্রোবের যাত্রার শেষ হবে। তবে ভয়েজার ১ আমাদের যা উপহার দিয়ে গেছে এবং এখনো দিয়েই চলেছে সেটার আমাদের সাধুবাদ জানানো উচিৎ। সবকিছুই সায়েন্সের নামে! জয় বিজ্ঞানের জয়!

Image Credit: Shutterstock

About the author

তাহমিদ বোরহান

আমি তাহমিদ বোরহান, বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন প্রযুক্তি ব্লগার হিসেবে পরিচিত। ইন্টারনেটে বাংলায় টেক কন্টেন্ট এর বিশেষ অভাব রয়েছে, তাছাড়া উইকিপিডিয়ার কন্টেন্ট বেশিরভাগ মানুষের মাথার উপর দিয়েই যায়। ২০১৪ সালে প্রযুক্তি সহজ ভাষায় প্রকাশিত করার লক্ষ্য রেখেই ওয়্যারবিডি (পূর্বের নাম টেকহাবস) ব্লগের জন্ম হয়! আর এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক আর্টিকেল প্রকাশিত করে বাঙ্গালীদের টেক লাইফ আরো সহজ করার ঠেকা নিয়ে রেখেছি!

সারাদিন প্রচুর পরিমাণে গান শুনি আর ইউটিউবে র‍্যান্ডম ভিডিও দেখি। ওয়ার্ডপ্রেস, ক্লাউড কম্পিউটিং, ভিডিও প্রোডাকশন, এবং ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনের উপরে বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে। নিজের গল্প, মানুষের গল্প, আর এলোমেলো টপিক নিয়ে ব্যাক্তিগত ব্লগে লিখি। খাওয়া আর ঘুম আমার আরেক প্যাশন!

Add comment

Categories