আগামীকাল কি বৃষ্টি হবে? জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অদূর ভবিষ্যৎতে বিশ্বের খাদ্য উৎপাদন কতটা ঝুঁকির মধ্যে থাকবে? শীঘ্রই কি আরেকটি স্টক মার্কেট বিপর্যয় আসবে? নির্দিষ্ট অঞ্চলে বন্যার থেকে খরা মৌসুম কি বেশি ক্ষতিকর হবে? এই টাইপের সকল প্রশ্নের উত্তর আমরা কম্পিউটার মডেলের মাধ্যমে দিতে পারি।
অতীতে কি হয়েছে বা অতীতের ঘটে যাওয়া ঘটনার উপর গাণিতিক বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যৎতের ঘটনার পূর্বানুমান করা; এটাই হচ্ছে কম্পিউটার মডেলের কাজ। ১৯৫০ সালের পর থেকেই কম্পিউটার মডেলের তুমুল ব্যবহার শুরু হয়। আর তখন থেকেই শক্তিশালি সায়েন্টিফিক কম্পিউটারগুলো দিয়ে জটিল সমস্যাগুলোর উপর সহজভাবে গবেষণা করা শুরু হয়; যেমন আকাশের দিকে না তাকিয়েই আবহাওয়ার পূর্বাভাস পাওয়া, ঝুঁকিপূর্ণ ব্লাস্টিং না ঘটিয়েই কিভাবে এটম বোমা কাজ করে সেটার গবেষণা করা ইত্যাদি।
আজ আমি আপনাদের সাথে আলোচনা করবো কিভাবে একটি কম্পিউটার মডেল কাজ করে!
মডেল কী?
সহজ ভাষায় মডেল হচ্ছে বাস্তবিক নকশা। একটি নকশাকে বাস্তব রূপ প্রদান করা যায় মডেলের মাধ্যমে। ছোট ছোট বাচ্চারা যে সব খেলনা দিয়ে খেলে সেগুলোই কিন্তু এক একটি মডেল। খেলনা বাড়ি, গাড়ি, প্রাণী ইত্যাদি সবকিছুই বাস্তাবিক বাড়ি, গাড়ি, প্রাণীর আদলে নির্মাণ করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বাচ্চারা এসকল খেলনা মডেলগুলোর মাধ্যমে বাস্তবিক বস্তুগুলোর সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান নিয়ে থাকে।
ঠিক তেমনি ভাবে একটি ব্রিজ নির্মাণ করার আগে নির্মাতারা খেলনা ব্রিজ তৈরি করে সেখানে খেলনা গাড়ি দিয়ে বিজ্ঞানিক গবেষণা করে থাকে; যাতে ব্রিজটি সঠিক ভাবে নির্মিত হতে পারে। এজন্যই NASA বিজ্ঞানীরা রকেট এবং স্পেস প্লেনের খেলনা মডেল বানিয়ে সেটাকে wind tunnels এর মধ্যে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে থাকে। বাস্তবিক জীবনের এই সকল মডেলকে বলা হয় ফিজিক্যাল মডেল (Physical Model)
গাণিতিক মডেল
বাস্তবিক জীবনের অনেক ক্ষেত্রে আমরা ফিজিক্যাল মডেল বানাতে পারি না। যেমন একটি অঞ্চলের আবহাওয়ার ফিজিক্যাল মডেল বানানো সম্ভব না কিংবা একটি কফি মেশিনের ভেতরের উৎপাদিত তাপমাত্রার ফিজিক্যাল মডেল বানানো যায় না। এ সকল ক্ষেত্রে আমাদেরকে গাণিতিক মডেল বা Mathematical Model এর উপর নির্ভর করতে হয়। গাণিতিক মডেলগুলো বিভিন্ন জটিল আলজেব্রা ইকোয়েশনের মাধ্যমে তৈরি হয়ে থাকে (যেমন a+b=2c÷d×e)। এই গাণিতিক মডেলের আলজেব্রার ইকোয়েশনের বিভিন্ন উপাদানকে বলা হয় Variables ।
a+b=2c÷d×e ইকোয়েশনে Variables হচ্ছে abcd এই অক্ষরগুলো। আর আবহাওয়ার পূর্বাভাস কাজে ব্যবহৃত গাণিতিক মডেলের আলজেব্রার ইকোয়েশনের Variables হবে বাতাসের প্রেসার, বাতাসের তাপমাত্রা, সমুদ্রের তাপমাত্রা, বাতাসের গতিবেগ ইত্যাদি। গাণিতিক মডেলগুলো আপনাকে ফিজিক্যাল মডেলের মতো উপাদানগুলোর ফিজিক্যাল রেজাল্ট দিতে পারবে না তবে গাণিতিক মডেলগুলোকে বিভিন্ন উপায়ে (যেমন গ্রাফ) ভিজুয়্যালভাবে রেজাল্ট দেওয়া যায়।
গাণিতিক মডেল এর জন্য কম্পিউটার
ছোট খাট সমস্যার সমাধানের গাণিতিক মডেলে কম্পিউটারের সাহায্যের দরকার হয় না। সহজ সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য আপনি নিজেই একটি গাণিতিক মডেল মনে মনেই সেটআপ করে ফেলতে পারবেন । যেমন উদাহরণস্বরূপ; আপনার বয়স ১০ বছর এবং আপনি জানতে চাচ্ছেন ২০ বছর বয়সে আপনার উচ্চতা কত হবে। এই প্রশ্নের একদমই সহজ উত্তর হচ্ছে দ্বিগুণ উচ্চতা হবে। কারণ বয়সও দ্বিগুণ হবে। তবে আগেই বয়সের তুলনায় বেশি লম্বা হয়ে গেলে এই উত্তরটি ভূল হবে। এবার প্রতি বছরে যদি নির্দিষ্ট পরিমানের উচ্চতা আপনি অর্জন করেন তাহলে সহজ গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে এই প্রশ্নের উত্তর আপনি নিজে নিজেই বের করে ফেলতে পারবেন।
২০ বছর বয়সে আপনার উচ্চতা এটাকে X ধরলাম, ১০ বছর বয়সে আপনার উচ্চতাকে A ধরলাম, ভবিষ্যৎতের কত বছর পরে আপনি উচ্চতা জানতে চান সেটাকে B ধরলাম এবং অতীতের বছরগুলোতে আপনি কত সেন্টিমিটার হারে লম্বা হয়েছেন সেটাকে C ধরলাম। তাহলে এই সমস্যার গাণিতিক মডেল হবে X = A + (B x C) ।
তো ১০ বছর বয়সে আপনার উচ্চতা ১৫০ সেন্টিমিটার (বা ৫ ফুট); প্রতি বছরে আপনি গড়ে ৫ সেন্টিমিটার হারে লম্বা হন তাহলে ১০ বছর পর মানে ২০ বছর বয়সে আপনার উচ্চতা হবে = 150 + (10 x 5) = 200 সেন্টিমিটার বা ৬.৫ ফুট। ২০ বছর বয়সে দ্বিগুণ উচ্চতা (১০ ফুট) এই অদ্ভুত অনুমানের থেকে এই অনুমানটি বেশ গ্রহণযোগ্য
অন্যদিকে একটি জটিল সমস্যার গাণিতিক মডেলের কথাই ধরুন। যেমন আবহাওয়ার পূর্বাভাসের জন্য গাণিতিক মডেলে শত শত, হাজার হাজার এমনটি কোনো কোনো সময় লক্ষাধিক ভিন্ন ভিন্ন Variable একে অপরের সাথে সংযুক্ত থাকে মানে এটা বেশ জটিল একটি সমীকরণ হয়ে দাড়ায়। এক্ষেত্রে এই সমীকরণকে হাতের মাধ্যমে সমাধান করতে গেলে কয়েকযুগ লেগে যেতে পারে। যেমন ১৯২০ দশকের দিকে গাণিতিক মডেলার Lewis Fry Richardson বিশ্বের প্রথম বিস্তারিত বিবরণযুক্ত আবহাওয়ার পূর্বাভাস তৈরি করেছিলেন। সেখানে তিনি মাত্র ৭টি ইকুয়েশন ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এই ৭টি ইকুয়েশন সম্পূর্ণ করতে তার এবং তার স্ত্রীর ৬ সপ্তাহের মতো সময় লেগেছিলো। মানে হচ্ছে আপনি আজকের আবহাওয়ার অবস্থা ৬ সপ্তাহ পরে জানতে পারবেন!
এই সকল জটিল সমীকরণকে দ্রুত সমাধানের জন্যেই গানিতিক মডেলগুলোকে কম্পিউটার ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বর্তমানে নাসায় সুপার কম্পিউটারের মাধ্যমে কোটি কোটি ইকুয়েশন দ্রুত গতিতে সমাধান করে আবহাওয়া, জলবায়ূ এবং মহাকাশের বিভিন্ন গবেষণা করা হচ্ছে যা কম্পিউটার ছাড়া সম্পাদন করা একদমই অসম্ভব হতো।
কম্পিউটার মডেলের ব্যবহারক্ষেত্র
কম্পিউটার মডেল ব্যবহার শুধুমাত্র আবহাওয়া এবং জলবায়ুর পূর্বাভাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বর্তমানে বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে শুরু করে ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিসিন এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক গবেষণার কাজে কম্পিউটার মডেল ব্যবহৃত হচ্ছে। নতুন এয়ারপ্লেনের কম্পিউটার মডেলের মাধ্যমে আমরা প্লেনটির বাস্তব কার্যক্ষমতা, আকাশে উড়ার সময় প্লেনটির বাতাসের চাপ সহ্য করার ক্ষমতা, পূর্ণ ফুয়েলে কত কিলোমিটার উড়তে পারবে সেটা হয় বিভিন্ন জিনিস জানতে পারছি।
উন্নত বিশ্বে রাস্তাঘাটে জ্যাম রোধ করার জন্য সম্পূর্ণ কম্পিউটার পদ্ধতিতে ট্রাফিক কনট্রোল করা হয়। আর এই ট্রাফিক কনট্রোলের কম্পিউটার মডেলের মাধ্যমে কিভাবে আরো সুক্ষ এবং উন্নত ট্রাফিক ব্যবস্থা উপহার দেওয়া যায় সে ব্যাপারেও নিয়মিত গবেষণা হচ্ছে। মহাকাশে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে বিজ্ঞানীরা দ্রুত সময়ে কম্পিউটার মডেলের মাধ্যমে উক্ত দুঘর্টনার সঠিক রিপ্লেরিংয়ের উপায়টি জেনে নেন। এই সকল কাজগুলোই একটি কম্পিউটারের সামনে বসেই করা সম্ভব!
কম্পিউটার মডেল কেন ব্যবহার করা হয়?
যেসকল গবেষণা এবং সমস্যার সমাধান স্বাভাবিক ভাবে মানুষের দ্বারা সমাধান করা সম্ভব হয় না যেসকল কাজে কম্পিউটার মডেল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বাস্তবে করা অসম্ভব এ ধরণের কাজগুলো আমরা কম্পিউটার মডেলের মাধ্যমে করে নিতে পারবো। একটি ১১০ তলা উচুঁ বিল্ডিয়ের ১০০টি ভিন্ন ডিজাইন তৈরি করে কোন ডিজাইনটি সবথেকে বেশি ভূমিকম্প সহনশীল এটা বাস্তবে বানানো একদমই অসম্ভব; কিন্তু এই একই কাজটি কম্পিউটার মডেলের মাধ্যমে করা যাবে! একটি যুদ্ধের ময়দানে আপনি বাস্তবে শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্য ৪টি ভিন্ন ভিন্ন পথ অবলম্বন করতে পারবেন না; তবে কম্পিউটার মডেলের মাধ্যমে এই ৪টি পথের উপর রির্সাচ করে সেরা পথটি বেছে নিতে পারবেন।
এছাড়াও অটোমোবাইল কোম্পানিগুলো তাদের তৈরিকৃত নতুন নতুন মডেলের গাড়িগুলোর বিভিন্ন টেস্ট এই কম্পিউটার মডেল এবং Prototypes ভার্সনের সাহায্যে করে থাকেন। এতে সময় ও অর্থ দুটোই সাশ্রয় হয়ে থাকে। অন্যদিকে একটি আগ্নেয়গিরি ভেতরের সঠিক তাপমাত্রা কতটুকু এটা কিন্তু কম্পিউটার মডেলের সাহায্য ছাড়া নির্ণয় করা সম্ভব হয় না।
কম্পিউটার মডেলের ইতিহাস:
আজকের পোষ্টের একদম শেষে চলে এসেছি। নিচের কম্পিউটার মডেলের ইতিহাসকে সংক্ষিপ্ত আকারে আমি দিয়ে দিলাম:
সময়কাল | ব্যবহার |
১৯২০ এর দশক | ৭টি গাণিতিক ইকুয়েশনের মাধ্যমে Lewis Fry Richardson আবহাওয়ার মডেলিং শুরু করেন। কিন্তু তখনকার সময়ে তিনি কম্পিউটারের সাহায্য নিতে পারেননি। |
১৯৪০ এর দশক | আমেরিকান ম্যাথমেথেশিয়ান John Von Neumann প্রথমবারের মতো মডেলিং এ কম্পিউটারের ব্যবহার শুরু করেন। |
১৯৫০ | ENIAC নামের সুপারকম্পিউটারকে বিশ্বে প্রথমবারের মতো কম্পিউটারাইজড আবহাওয়ার পূবাভার্স হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়। |
১৯৬০ | আবহাওয়া এবং জলবায়ুর উপর জটিল গবেষণার কাজে কম্পিউটার মডেলের ব্যবহার শুরু হয় এবং এ কাজে NCAR (National Center for Atmospheric Research) প্রতিষ্ঠিত হয়। |
১৯৭২ | বায়ুবিজ্ঞানী Edwin Lorenz তার বিখ্যাত প্রশ্নের মাধ্যমে Chaos Theory গণিতের সূচনা করেন। |
১৯৭২ | The Club of Rome নামের একটি একাডেমিক গ্রুপ কম্পিউটার মডেলের মাধ্যমে বিশ্বের সকল রিসোর্সকে পরিমাপ করেন এবং এই সকল রিসোর্স শেষ হতে মানুষের কত বছর সময় লাগবে সেটাও নির্ধারণত করতে সক্ষম হন। |
১৯৮০ এর দশক | অপেক্ষাকৃত কমদামী কম্পিউটারের জন্য স্প্রেডশীট প্রোগ্রাম নির্মিত হয়, যাতে গড়ে সবাই সহজ কম্পিউটার মডেলের ব্যবহার করতে পারে। |
১৯৯০ এর দশক | ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বের অনেকগুলো সাধারণ কম্পিউটারকে বিজ্ঞানীরা বড়সড় জটিল কম্পিউটার মডেলিংয়ের কাজে লাগাতে সক্ষম হন। এদের মধ্যে [email protected] এবং [email protected] হচ্ছে এই ধরণের উল্লেখযোগ্য প্রজেক্ট। |
২০০৩ | জলবায়ু বিজ্ঞানীরা Climateprediction.net নামের ওয়েবসাইট চালু করেন। এর মাধ্যমে বিশ্বের যে কেউ তার কম্পিউটারকে জলবায়ুর পূর্বাভাসের কাজে লাগাতে পারার ব্যবস্থা করা হয়। |
২০১৬ | শিকাগোর পুলিশ কম্পিউটার মডেলের মাধ্যমে শহরের মানুষের অপরাধ করার পূর্বাভাস পান এরকম খবর ছড়িয়ে পড়ে। |
আমাদের বর্তমান ডিজিটাল প্রজন্মের অগ্রগতির পেছনে কম্পিউটার মডেলের অনেক বড় অবদান রয়েছে। বিশেষ করে মেডিক্যাল এবং আবহাওয়ার ক্ষেত্রে কম্পিউটার মডেলের বিকল্প নেই।
কম্পিউটার মডেলের সাহায্য ছাড়া দ্রুত সময়ে সঠিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস, প্রাকৃতিক দূযোর্গের পূর্বাভাস এগুলোর কোনো কিছুই সম্ভব হত না। অনান্য সকল টেকনোলজি বিষয়ের মতো কম্পিউটার মডেলকেও বিজ্ঞানীরা দিন দিন আরো উন্নত করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
WiREBD এখন ইউটিউবে, নিয়মিত টেক/বিজ্ঞান/লাইফ স্টাইল বিষয়ক ভিডিও গুলো পেতে WiREBD ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুণ! জাস্ট, youtube.com/wirebd — এই লিংকে চলে যান এবং সাবস্ক্রাইব বাটনটি হিট করুণ!
Images: Shutterstock.com